আশির দশকের মাঝামাঝি সময় ব্যান্ড মিউজিকের ঘরানায় একটি পরিবর্তন আসে। এ সময় মেটাল ঘরানার অনুপ্রবেশ ঘটে এই ব্যান্ড জগতে। তৎকালীন সময়ে বিশ্বে মূলত থ্র্যাশ মেটাল এবং হেভি মেটাল ধারা বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে এর চর্চা শুরু হয়। ১৯৮৪ সালে একটি মেটাল ব্যান্ডের জন্ম হয় বাংলাদেশে, নাম ওয়ারফেজ। এটি ছিল মূলত একটি হেভি মেটাল ব্যান্ড। তারপর মানুষের মণিকুটরে স্থান করে নেয় মাইলস, এলআরবি ফিডব্যাক, ফিলিংস, সোলস-এর মতো জনপ্রিয় রক ব্যান্ডগুলো। কিন্তু শুরুর দিকে ব্যান্ড সংগীতের যে জনপ্রিয়তা ছিল তা এখন কমতে বসেছে। তারপরও নতুন ব্যান্ডদের সৃষ্টি থেমে থাকেনি। একে একে জন্ম নিয়েছে বেশ কিছু ভালো ব্যান্ড দল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ব্যান্ড দলগুলোকে নিয়ে বাংলাদেশে কাজ শুরু করে বাংলাদেশ ব্যান্ডস অ্যাসোসিয়েশন (বামবা)। তাদের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের ছোট-বড় সব মিলিয়ে ৩৬টি ব্যান্ড দল। তার মধ্যে কার্যকরভাবে সারা দেশে আছে ২৪টি ব্যান্ড। এর মধ্যে রয়েছে নগরবাউল, মাইলস, এলআরবি, সোলস, ফিডব্যাক, রেনেসাঁ , মাকসুদ ও ঢাকা, অবসকিউর, ওয়ারফেজ, প্রমিথিউস, দলছুট, অর্থহীন, ক্রিপটিক ফেইট, শিরোনামহীন, মেটাল মেইজ, পাওয়ার সার্জ, মেকানিঙ্, নেমেসিস আর্বো ভাইরাস, রেডিও অ্যাকটিভ, বেদুইন, নাগরিক, দৃক, ডার্ক ইত্যাদি।
ব্যান্ড দল নগরবাউল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৭ সালে। আর এই ব্যান্ডের প্রধান হিসেবে আছেন মাহফুজ আনাম জেমস। শুরুতে ফিলিংস নামে যাত্রা শুরু করলেও পরে নাম পাল্টিয়ে গড়ে তোলা হয় নগরবাউল। এ পর্যন্ত নগরবাউলের অ্যালবাম সংখ্যা সাতটি। প্রথম অ্যালবাম ছিল-'স্টেশন রোড'।
ব্যান্ড এলআরবি। পুরো নাম লাভ রানস ব্রাইন্ড। '৯০ সালে যাত্রা শুরু করেছিল কিংবদন্তি এ ব্যান্ডটি। শুরুতে নাম রাখা হয়েছিল লিটল রিভার ব্যান্ড। এ ব্যান্ডটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আইয়ুব বাচ্চু। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ডাবল অ্যালবাম প্রকাশ করেছিল এলআরবি। এ পর্যন্ত এলআরবির অ্যালবাম সংখ্যা ১৫টি। শিরোনামহীন ব্যান্ডটি ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ভোকাল তুহিন ও বেজিস্ট জিয়া ব্যান্ডটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ব্যান্ডটি শুরু থেকেই নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে গান পরিবেশন করে আসছে। পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্র এবং দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের সফল ব্যবহার তাদের আলাদা করেছে অন্য ব্যান্ড থেকে।
হেভি মেটাল ব্যান্ড আর্টসেল। এই ব্যান্ড মূলত সংগীতের প্রগতিশীল মেটাল ধারা অনুসরণ করে। তারা অন্যান্য ধারার সংগীতের ওপরও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরীক্ষা চালিয়েছে। ব্যান্ডটির বয়স প্রায় ১৫ বছর। আর্টসেল ১৯৯৯ সালের আগস্ট মাসে গঠিত হলেও একই বছরে নভেম্বর মাসে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে আত্দপ্রকাশ করে। ওয়ারফেজ বাংলাদেশের একটি হার্ড রক মেটাল ব্যান্ড। ১৯৮৪ সালে ওয়ারফেজ দলটি গঠিত হয়। ১৯৯১ সালে 'ওয়ারফেজ' নামক অ্যালবামের মাধ্যমে ব্যান্ডটির যাত্রা শুরু। এই অ্যালবামটি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর লাইনআপে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। প্রথম লাইনআপের অধিকাংশ সদস্য সেইন্ট জোসেফ হাইস্কুলের ছাত্র ছিল। মিজান, কমল, অনি, টিপু, রজার, শামস এবং সামির।
ফিডব্যাক গান করছে প্রায় ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। দেশের শুরুর দিকের ব্যান্ডগুলোর একটি। সত্তর দশকে এদের যাত্রা শুরু। বাংলাদেশি পপসংগীতের ইতিহাসে ফিডব্যাকের ব্যাপক অবদান। ১৯৮৭ সাল থেকে ফিডব্যাক পুরোদমে বাংলা রক মিউজিক নিয়ে কাজ শুরু করে।
নব্বই দশকের মাঝামাঝির দিকে বাংলা সফট-রক ব্যান্ড 'ফিডব্যাক' তাদের এপিক লোকগীতিভিত্তিক ফিউশন অ্যালবাম 'বাউলিয়ানা' প্রকাশ করে, যা কিনা দেশি তরুণদের গানের স্বাদে আমূল পরিবর্তন করেছিল; এমনকি পরবর্তীতে বাংলা ব্যান্ডের ধারাকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ১৯৯৬ সালে লিড ভোকাল মাকসুদ ব্যান্ড ছেড়ে দেন। গতানুগতিক ধারা থেকে বের হয়ে সমাজ সচেতনমূলক গান করাই মাকসুদ ফিডব্যাক ছেড়ে দেওয়ার কারণ হিসেবে দেখান। ফুয়াদ নাসের বাবু, পিয়ারু খান, লাবু রহমান, পন্টি এবং লুমিন বর্তমান সদস্য। রক ব্যান্ড দলছুট। ১৯৯৬ সালে বাপ্পা মজুমদার ও সঞ্জীব চৌধুরী একসঙ্গে এই ব্যান্ড গঠন করেন। প্রথমে কেবল বাপ্পা ও সঞ্জীব দলের সদস্য থাকলেও অর্থহীন ব্যান্ডের সুমন তাদের সাহায্য করেছিলেন। ১৯৯৭ সালে দলছুট তাদের প্রথম অ্যালবাম আত্দপ্রকাশ করে। বাংলাদেশের অন্যতম একটি ব্যান্ড অর্থহীন। এ ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা এবং দলনেতা সুমন। ১৯৯৯ সালে শুরু হওয়া এই ব্যান্ডের এখন পর্যন্ত ৫টি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। তাদের প্রথম অ্যালবাম ত্রিমাত্রিক প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে। ১৯৮৬ সালের কথা। আরিফ, রেজওয়ান ও শারেক একসঙ্গে গান করতেন। তাদের সঙ্গে জ্যামিং করতেন বন্ধু কোয়েলও। তখন আবার 'কিউপিড' নামে একটি ব্যান্ড ছিল। কোয়েলের মাধ্যমে একদিন আরিফ, রেজওয়ান ও শারেকদের সঙ্গে পরিচয়। এরপর সবাই মিলে ভাবতে থাকি একটি নতুন ব্যান্ড গড়ার। সেটাই আজকের প্রমিথিউস।' বর্তমান লাইনআপ : বিপ্লব, সোহাগ, পল্লব, মাইকেল, রুবেল। ২৪ বছর পেরিয়ে পঁচিশের ছায়াপথে হাঁটছে ব্যান্ডটি। শীঘ্রই বাজারে আসছে ব্যান্ডের ১৫তম অ্যালবাম 'ছায়াপথ'।
রেনেসাঁ ব্যান্ড সাধারণত রেগে, জ্যাজ ও সফট রক ধরনের গান করে থাকে। রেনেসাঁ ব্যান্ডটি ১৯৮৫ সালে গঠিত হয়। এই ব্যান্ডের সবাই ছোটবেলা থেকে গান করছেন বা বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছেন। ১৯৮৫ সালে নকীব খান সোলস ব্যান্ড ছেড়ে ঢাকায় আসার পর এই ব্যান্ড গঠন করেন। ১৯৭২ সালের শেষের দিকে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত সোলস ব্যান্ডটি। অসংখ্য জনপ্রিয় গান দিয়ে শ্রোতাদের মন কেড়ে নিয়েছে সোলস। মুখরিত জীবন, মন শুধু মন ছুঁয়েছে, নিঃসঙ্গতা, রিমঝিম বৃষ্টি- এসব গান এখনো থাকে বন্ধুদের আড্ডায়। তপন চৌধুরী, আইয়ুব বাচ্চু, নকীব খানের মতো গুণী শিল্পীরা স্থাপন করেছিলেন এই ক্লাসিক্যাল বাংলা ব্যান্ডের ভিত্তি।
'প্রাপ্তবয়স্কের নিষিদ্ধ' (১৯৯৭) অ্যালবামের মাধ্যমে আত্দপ্রকাশ করা 'মাকসুদ ও ঢাকা', দ্বিতীয় অ্যালবাম 'ওগো ভালোবাসা' প্রকাশ করে ১৯৯৯ সালে। এরপর তাদের বিরতির দৈর্ঘ্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ বছরে। খুলনায় ১৯৮৪ সালে জন্ম নেয় অবসকিউর ব্যান্ডটি। কয়েকজন মিলে তৈরি করলেন একটি ব্যান্ড। নাম দিলেন অবসকিউর। ব্যান্ড গঠনের পর গান গাওয়ার চেয়ে গান লেখা এবং সুর করার কাজটাই বেশি হতো তাদের। এভাবে তারা ৩০টি গান তৈরি করে ফেলেন। নেমেসিস মূলত অল্টারনেটিভ রক ধারার গান করছে। তাদের অনুপ্রেরণা হচ্ছে ইউ টু, অর্থহীন, আর্টসেল, ব্ল্যাক, অর্ণব, ও বাংলা ব্যান্ডসহ আরও অনেকে। ১৯৯৯ সালের দিকে তারা একদল স্কুলবন্ধু মিলে গড়ে তুলেছিলেন ব্যান্ড 'নেমেসিস'। শুরুর দিকে তারা ছোট ছোট বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অল্প বিস্তর গান পরিবেশন করতেন। তখন তারা গান করতেন আন্ডারগ্রাউন্ড ব্যান্ড হিসেবেই।
নেমেসিসের গানগুলো দ্রুত জনপ্রিয়তা পেলে সেই সুবাদে ২০০৫ সালে একটি রেকর্ড কোম্পানি তাদের অ্যালবাম প্রকাশে আগ্রহ দেখায়। তাদের প্রথম অ্যালবাম 'অন্বেষণ' প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাদের মূলধারার ব্যান্ড সংগীতে আত্দপ্রকাশ।
হার্ড রক ব্যান্ড ড্রিক। দেশজুড়ে দুবার ট্রিবিউটসহ প্রায় ২০০-এরও বেশি স্টেজশো করে দর্শক মাতিয়েছেন তারা। মেটাল ব্যান্ড মেটাল মেইজ। সবার কাছে এমএম নামেই পরিচিত। ১৯৯৫ সালে রক এবং মেটাল মিউজিক দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ব্যান্ডটি গড়ে ওঠে। ২০০১ সালে ছাড়পত্র অ্যালবামের ডিবাট সং প্রশ্ন ম্যাসিভ হিটে পরিণত হয়। তারপর এক এক করে ছয়টি সিঙ্গেল ট্র্যাক রিলিজ করে বিভিন্ন মিঙ্ড অ্যালবামে।