১৩ আগস্ট ২০১১। হঠাৎ করেই ছড়িয়ে পড়ল একটি খবর। নির্মাতা তারেক মাসুদ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত। নিমিষেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল বাংলাদেশ। অসম্ভব মেধা নিয়ে জন্মানো এই চলচ্চিত্রকারের সব স্বপ্ন সেদিন থেমে গিয়েছিল। সঙ্গে আমাদের চলচ্চিত্রের সমৃদ্ধির পথেও দেয়াল উঠে গেল। সেদিন থেকে '১৩ আগস্ট' আমাদের জীবনে বেদনার দিন। আজ সেই দিন। দেখতে দেখতে চলে গেছে ৩টি বছর।
তারেক মাসুদ ছিলেন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। সেলুলয়েড ফিতায় তিনি স্বপ্ন বুনে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই তিনি চলচ্চিত্রের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নেন। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফার সানি্নধ্যে থেকে তিনি নিজেকে করেছেন মানসিকভাবে সমৃদ্ধ। স্বপ্ন দেখতেন চলচ্চিত্র নির্মাণের। শুরুতেই চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানকে নিয়ে ১৯৮২ সালের শেষ দিকে তিনি নির্মাণ করেন জীবনের প্রথম ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র। 'আদম সুরত' শিরোনামে এই ডকুমেন্টারি ১৯৮৯ সালে মুক্তি পায়। শুরুতেই নিজের জাত চিনিয়ে দেন তিনি।
'আদম সুরত'র পর তারেক মাসুদ বেশ কিছু ডকুমেন্টারি ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এরপরই তার মাথায় আসে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের চিন্তা। কিন্তু বিষয় কি? অনেক ভেবে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, নিজের বাল্যকাল তিনি গল্পে নিয়ে আসবেন। তারেক মাসুদ পড়তেন মাদ্রাসায়। সেই জীবন নিয়ে তিনি পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন। নাম রাখেন 'মাটির ময়না'। ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থা এবং মুক্তিযুদ্ধ উঠে আসে গল্পে। ২০০২ সালে তিনি নেমে পড়েন 'মাটির ময়না' নির্মাণে। সবকিছু ঠিকমতোই এগুলো। চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেল। তারপর? বাকিটা প্রত্যেক সচেতন বাঙালিই জানেন। 'মাটির ময়না' শুধু একটি চলচ্চিত্র নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের 'মেরুদণ্ড'। এই চলচ্চিত্রটি দিয়েই বাংলাদেশি চলচ্চিত্র গ্রহণযোগ্যতা পায় 'কান চলচ্চিত্র উৎসবে'।
তারেক মাসুদ এরপর আরও ২টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। চলচ্চিত্র দুটি ছিল 'অন্তর্যাত্রা' এবং 'রানওয়ে'। অসংখ্য ডকুমেন্টারি নির্মাণ করেছেন তিনি।
ক্ষণজন্মা এই মানুষটি মৃত্যুর সঙ্গে আলিঙ্গন করেছেনও একটি চলচ্চিত্রের স্বপ্ন বুকে নিয়ে। সেটির নাম 'কাগজের ফুল'।
তারেক মাসুদকে বলা হয় স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। তিনি যে স্বপ্ন দেখতেন তা পুরোটা সফল করে যেতে পারেননি। কিন্তু সেগুলো সফল করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন তার জীবনসঙ্গী, নির্মাণসঙ্গী এবং ভাবনাসঙ্গী ক্যাথরিন মাসুদ। তিনি 'তারেক মাসুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট' গড়েছেন। এখান থেকে তিন ধরনের কাজ করা হচ্ছে। প্রকাশনার কাজ, ফিল্ম নির্মাণ এবং একটি ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরি করা। আর্কাইভে মুক্তিযুদ্ধের দলিলও রাখা হচ্ছে।
তারেক মাসুদ নিজের চলচ্চিত্র নিয়ে সারা দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এই কাজটিও চালিয়ে যাচ্ছেন ক্যাথরিন। তিনি বলেন, 'তারেক যেখানে শেষ করেছেন, আমরা সেখান থেকেই শুরু করেছি। এরই মধ্যে আমরা ৪০টিরও বেশি জায়গায় চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছি। শুধু তাই নয়, তারেক মাসুদ 'সিনেমা হল বাঁচাও' নামে যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, সে আন্দোলনও চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। চলচ্চিত্র শিল্পকে কিভাবে আরও বেশি কর্মমুখর করে তোলা যায় সেই চেষ্টা করছি।
এসবের পাশাপাশি 'কাগজের ফুল' নির্মাণ প্রক্রিয়া চলছে। ক্যাথরিন বলেন, সব কিছু আবার নতুন করে করতে হচ্ছে। ফলে আমাদের কিছুটা বেশি সময় লাগছে। তবে তারেকের স্বপ্ন 'কাগজের ফুল' এক দিন ফুটবেই।