নাটক সমাজের দর্পণ। অভিনয়ের রসবোধ, সংলাপ প্রক্ষেপণ ও শারীরিক ভাষার পরিশীলিত উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে নাট্যকর্মীরা সামাজিক অসংগতিগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি সমাজ পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে থাকেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বেইলি রোডের মহিলা সমিতি ও গাইড হাউসকেন্দ্রিক নাটকের চর্চা গড়ে উঠলেও কালের পরিক্রমায় নাটক সরণিখ্যাত বেইলি রোডের এই দুটি মিলনায়তন থেকে নাটক বিচ্যুত হয়। অন্যদিকে নাটকের প্রসারে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মহানগর নাট্যমঞ্চ নির্মাণ হলেও কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও অসততার কারণে গুলিস্তান এলাকার এই মিলনায়তনটি বখাটে, মাদকাসক্ত ও ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। এরপর নাটকের প্রসারে সূত্রাপুরের জহির রায়হান মিলনায়তনটি নির্মাণ করা হলেও এই মঞ্চটিও নানা কারণে অবহেলিত। শিল্পচর্চার বেইলি রোডে কঠিন বাণিজ্যিকতার জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে বেইলি রোডের নাটকের চর্চার যখন করুণ পরিণতি ঘটে তখন শিল্প-সংস্কৃতির এই মাধ্যমকে নতুন রূপদানের কাজে এগিয়ে আসে শিল্পকলা একাডেমি। নাটকের চর্চা ও বিকাশে একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তন, পরীক্ষণ থিয়েটার হল ও স্টুডিও থিয়েটার হল এই তিনটি মিলনায়তন নির্মাণ করা হয়। ২০০১ সালের ১৪ জুন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন জাতীয় নাট্যশালার পরীক্ষণ থিয়েটার হল। ওই সময় মাসব্যাপী নাট্য উৎসবের মধ্য দিয়ে নাট্যকর্মীরা এই মিলনায়তনটির ব্যাপক পরিচিতি ঘটান। এরপর ২০০৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনের উদ্বোধন করেন। এই মিলনায়তনগুলো চালু হওয়ার পর নাটকের বিকাশ গত কয়েক দশকের চেয়ে আরও একধাপ এগিয়ে যায়। একদিকে শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তনগুলো নাটকের বিকাশ ও প্রসারে এগিয়ে এলেও অন্যদিকে বন্ধ হয়ে যায় নাটককেন্দ্রিক বেইলি রোডের মহিলা সমিতি ও গাইড হাউসের দুটি মিলনায়তন। এ দুটি মিলনায়তন বন্ধ হওয়ার পর জাতীয় নাট্যশালার মিলনায়তনগুলোতে নাটক মঞ্চায়ন বৃদ্ধি পেলেও মিলনায়তনের অপ্রতুলতায় বেশির ভাগ দলই তাদের নিয়মিত প্রযোজনার নাটকগুলো মঞ্চায়ন করতে পারছে না। সারা দেশে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনভুক্ত সাড়ে তিন শতাধিক নাটকের দল নাট্যচর্চায় নিবেদিত থাকলেও বেশির ভাগ দলই মঞ্চের অভাবে তাদের বিকাশ ঘটাতে পারছে না। শুধু রাজধানী ঢাকায়ই রয়েছে শতাধিক নাটকের দল। শীর্ষস্থানীয় দলগুলো ছাড়া অন্য দলগুলো হল পাচ্ছে না বলে নাট্যচর্চায় ব্যাঘাত ঘটছে। শীর্ষস্থানীয় দলগুলো ছাড়া অন্য দলগুলোর কাছে শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তন পাওয়াটা সোনার হরিণ পাওয়ার মতো হয়ে পড়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তন, পরীক্ষণ থিয়েটার হল ও স্টুডিও থিয়েটার হল- এই তিনটি হল নাটকের প্রসারে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে নাট্যকর্মীদের মনে নাটক নিয়ে নতুন আশার সঞ্চার ঘটেছে।
নাট্যচর্চায় শিল্পকলা একাডেমির ইতিবাচক ভূমিকা নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) বিশ্বসভাপতি রামেন্দু মজুমদার বলেন, বেইলি রোডের মহিলা সমিতি ও গাইড হাউস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর নাটকের বিকাশে ও চর্চায় শিল্পকলা একাডেমি ইতিবাচক ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসে। এতে নাট্যকর্মীদের মনে নতুন করে আশার সঞ্চার ঘটে। মিলনায়তনের ভাড়াও সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। তবে মহড়া কক্ষের ভাড়া একটু বেশি।
চলতি বছরের শেষদিকে মহিলা সমিতির নির্মাণাধীন দুটি মঞ্চ চালু হলে এ সমস্যা অনেকাংশে লাঘব হবে বলে মনে করেন নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মতো রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতেও মঞ্চ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলেও তিনি মনে করেন। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের দলপ্রধান আতাউর রহমান বলেন, আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত মঞ্চের দাবিতে নাট্যকর্মীরা দীর্ঘদিন যাবৎ সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছিল। নাট্যকর্মীদের দাবির মুখে সরকার শিল্পকলা একাডেমিতে জাতীয় নাট্যশালা নির্মাণ করে। এই নাট্যশালার তিনটি মিলনায়তন নাট্যকর্মীদের নাট্যচর্চায় যে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। তবে নাটকের দলের তুলনায় মঞ্চের সংখ্যা একেবারে কম। তাই শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চের পাশাপাশি রাজধানীর মিরপুর, উত্তরাসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মঞ্চ নির্মাণ অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে বলে আমি মনে করি। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা নাটকের চর্চায় এগিয়ে আসার ইতিবাচকতা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল আকতারুজ্জামান বলেন, নাট্যকর্মীদের আন্দোলনের মুখে জাতীয় নাট্যশালার পথচলা শুরু হয়। অর্থাৎ নাট্যকর্মীদের আন্দোলনের ফসলই হচ্ছে জাতীয় নাট্যশালার তিনটি মিলনায়তন। এটা কোনো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান নয়। তবে এই মিলনায়তনগুলো নাট্যকর্মীদের বিকাশ ও প্রসারে প্রতুল নয়। জাতীয় নাট্যশালা নাটক মঞ্চায়নের জন্য নির্মাণ হলেও মূল মিলনায়তনে মাঝে মাঝে নাচ এবং গানের প্রোগ্রাম হয়ে থাকে। এতে নাট্যকর্মীদের অনেকটা সমস্যা হয়ে থাকে। নাটক মঞ্চায়নের এই মিলনায়তন অন্য অনুষ্ঠানের জন্য ভাড়া দেওয়া যুক্তিসঙ্গত নয়।