বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের ইতিহাস হাজার বছরের। লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন ধাপে ধাপে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে নাটকের বিভিন্ন উপাদান। শৈল্পিকতা আর নান্দনিকতার পরিশীলিত সমীকরণে মঞ্চনাটককে অভিনয়ের পাঠশালা বলা হয়ে থাকে। মঞ্চ শুধু অভিনয়ই শেখায় না, শেখায় শৃঙ্খলাবোধ ও সময়জ্ঞান। বলা হয়, মঞ্চে কাজ না করলে একজন অভিনয় শিল্পীর জীবনে পূর্ণতা আসে না। নাটকের শৈল্পিকতা ও সৃজনশীলতার বিকাশে মঞ্চের গুরুত্ব অপরিসীম। মঞ্চে কাজ করেই বর্তমানকালের সব নাট্যব্যক্তিত্ব নিজেকে মর্যাদার আসনে উন্নীত করেছেন। কিন্তু কালের পরিক্রমায় নাটকের এ অঙ্গনে বর্তমানে শিল্পী সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। শিল্পী সংকটের কারণে নাট্যচর্চার বিকাশও থমকে গেছে। তবে বিষয়টি নিয়ে নাট্যজনদের মধ্যেও রয়েছে নানা ধরনের মতভেদ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইটিআই সভাপতি নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, 'টিভি নাটকের প্রসারের কারণেই শিল্পীরা মঞ্চের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পী টিভি নাটকের ব্যস্ততার কারণেই মঞ্চে সময় দিতে পারছে না। তবে পেশাদারিত্বের অভাবে মঞ্চে শিল্পী সংকট তৈরি হয়েছে। মঞ্চে যদি পেশাদারিত্ব থাকত তাহলে এ সংকট তৈরি হতো না। টেলিভিশনের ব্যস্ততার কারণে অনেকে মঞ্চে সময় দিতে না পারলেও তাদের শূন্যস্থান কিন্তু কেউ না কেউ পূরণ করছেই।' তবে মঞ্চ থেকে টেলিভিশনে চলে যাওয়াটা মঞ্চের জন্য ক্ষতিকর বলেও তিনি মনে করেন। টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যাধিক্যের কারণে টিভি নাটকের প্রসার এবং এ জন্য মাত্রাতিরিক্ত ব্যস্ততা- ফলে নাটকের এ মাধ্যমটি নিয়ে শঙ্কিত নাট্যবোদ্ধারা।
শিল্পী সংকটের বিষয়ে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ও আইটিআই বাংলাদেশ কেন্দ্রের সভাপতি নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বলেন, 'মঞ্চে যশ, খ্যাতি, অর্থ, প্রতিপত্তি- কোনোটিই নেই। তাই শিল্পীরা এ মাধ্যমটির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।' তিনি আরও বলেন, 'বিশ্বায়নের এই যুগে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় অর্থই মানুষের কাছে মুখ্য বিষয় হয়ে পড়েছে। নাট্যকর্মীরাও যেহেতু রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ, অতএব অর্থের প্রতি তাদের আগ্রহ থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। জীবন-জীবিকা ও সামাজিক মর্যাদাসহ পরিবার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র সর্বত্রই অর্থ এক বিরাট ফ্যাক্টর হয়ে দেখা দিয়েছে। শুধু আমাদের দেশেই নয়, মঞ্চে নাট্যকর্মী সংকট পৃথিবীর সবখানেই।' সমস্যা উত্তরণে মঞ্চে পেশাদারিত্ব তৈরি প্রয়োজন। এ জন্য বাণিজ্যিকভাবে নাটকের মঞ্চায়ন অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে বলেও তিনি মনে করেন। নাসিরউদ্দিন ইউসুফের মতে, শুধু রাজধানীতেই নয়, সারা দেশেই বাণিজ্যিকভাবে নাটক মঞ্চায়ন করতে পারলে মঞ্চের শিল্পীদের মধ্যে পেশাদারিত্ব তৈরি হবে। অশ্লীল কিছু না করে কমার্শিয়ালি নাটক করতে পারলে এ সমস্যা অনেকাংশে লাঘব হবে বলে তিনি মনে করেন। নাট্যবোদ্ধাদের অনেকের মতে, পুরুষ নাট্যকর্মীদের শূন্যস্থান কেউ না কেউ পূরণ করছেই। তবে নারী নাট্যকর্মীরা নানা কারণে মঞ্চের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্র মাধ্যমে কাজ করে একদিকে নাম, যশ, খ্যাতির পাশাপাশি অল্প সময়ে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার সুযোগ থাকলেও মঞ্চে এ সুযোগ নেই। অন্যদিকে নানা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার পরও নারী নাট্যকর্মীদের রয়েছে আরও নানা ধরনের প্রতিকূলতা। সব মিলিয়ে এ মাধ্যমটির প্রতি নারী নাট্যকর্মীরা বহু আগেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। আবার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাটক ও নাট্যতত্ত্বে পড়াশোনা করে উত্তীর্ণরাও মঞ্চের দিকে ঝুঁকছে না। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে কাজের সুযোগ না পাওয়ার ক্ষোভে অনেকে দীর্ঘদিন মঞ্চে কাজ করেও এক সময় ক্ষোভ ও দুঃখ নিয়ে মঞ্চকে বিদায় জানাচ্ছেন বলেও মনে করছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনভুক্ত বিভিন্ন নাট্যদলের কর্মীরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল ঝুনা চৌধুরী বলেন, 'মঞ্চে নাট্যকর্মী সংকট- বিষয়টি মানতে আমি নারাজ। এটি একেবারেই ভুল কথা। প্রতিটি দলেই বিপুলসংখ্যক নাট্যকর্মী রয়েছে।' তিনি আরও বলেন, 'মঞ্চের আবেদন কখনো শেষ হবে না। যতদিন নাটক থাকবে এবং মানুষ থাকবে ততদিন মঞ্চের আবেদন একই রকম থাকবে।'