চলচ্চিত্রে কিছু কমন ডায়ালগ আছে, যা যুগ যুগ ধরে চলছে। সেই শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালার গল্পে কুমিরের একই ছানাকে বার বার দেখানোর মতো। যেমন ভিলেন নায়িকাকে আক্রমণ করলে নায়িকার মুখে প্রথমেই শোনা যায়- 'ছেড়ে দে শয়তান' কিংবা নায়িকার মা অথবা বাবা মৃত্যুর সময় নায়কের হাতে মেয়ের হাত সঁপে দিয়ে বলে- 'বাবা কথা দাও তুমি আমার মেয়েটাকে দেখে রাখবে'। এমন অনেক গতানুগতিক ডায়ালগ শুনতে শুনতে এগুলো একসময় দর্শকের গা-সওয়া হয়ে গেছে। তারা সহজেই বুঝে নিতে পারে পরবর্তী দৃশ্য বা গল্পের পরিণতি কি হবে। তবে নব্বই দশকের শেষ ভাগ থেকে নির্মাতা ও নায়ক নায়িকার মুখে নতুন কিছু ডায়ালগ সংযোজন হয়েছে। এগুলো অবশ্য ছবিতে নয়, বাস্তবে।
যেমন একজন নির্মাতা বলেন, 'আমার ছবির গল্পটি একেবারেরই ব্যতিক্রম' এবং শিল্পী বলেন,'ছবিতে আমার ক্যারেক্টার একবারেই ভিন্নধর্মী, এতে নতুনত্ব আছে'। দুজনের এমন আত্দবিশ্বাসী ডায়ালগ পরে পর্দায় খুঁজে পাওয়া যায় না। নায়ক-নায়িকার প্রেম মেনে নিতে পারছে না তাদের বাবা-মা। কারণ ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য তাদের মাঝে বাধার প্রাচীর হয়ে আছে। এরই মাঝে আবার ভিলেনের আগমন। গৎবাঁধা গান, অ্যাকশন, আর সেন্টিমেন্ট। সবশেষে গুদামঘরে নায়িকা এবং বাবা-মা, আত্দীয় স্বজনরা ভিলেনের হাতে বন্দী। তাদের উদ্ধারে অতিমানবীয় শক্তিতে নায়কের আগমন এবং একাই নায়কের হাতে ডজন ডজন ভিলেন ধরণী তল প্রপাত। অতঃপর মহামিলনের মধ্য দিয়ে গল্প শেষ করতে হবে। তাই 'ধনী-দরিদ্র মিলিয়া মিশিয়া পরম সুখে দিন কাটাইতে লাগিলো'। এই হলো নির্মাতা ও শিল্পীর ব্যতিক্রমী আর একবারেই অন্যরকম গল্প এবং চরিত্রের নমুনা। তবে মাঝেমধ্যে যে কিছু নতুন গল্পের ছবি হয় না তা কিন্তু নয়। এসব ছবিতে সংলাপ, গান, কাহিনী ব্যঞ্জনায় নতুনত্বের কারণে দর্শক আগ্রহ নিয়ে তা সাদরে গ্রহণ করে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো গিয়াসউদ্দীন সেলিমের 'মনপুরা' কিংবা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর 'টেলিভিশন'। এই গতানুগতিকতার কারণ সম্পর্কে দুই নির্মাতা কি বলেন-
গিয়াসউদ্দীন সেলিম
এ অবস্থার কারণ হিসেবে প্রথমেই আমি চিত্রনাট্যকারের অভাবকে দায়ী করব। চলচ্চিত্রে যোগ্য চিত্রনাট্যকারের অভাব চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে কারও কোনো চেষ্টা নেই। তাই স্বাভাবিকভাবেই নকল এবং গতানুগতিকতার পথ ধরে হাঁটছে অনেকে। হলিউড ও বলিউডের ছবির অন্ধ অনুকরণ করেই চলেছে তারা। এর বাইরে যাওয়ার চেষ্টাও নেই তাদের। ফলে একই গল্প, সংলাপ আর চরিত্র দেখতে দেখতে দর্শক এখন ক্লান্ত, দেশীয় সিনেমাবিমুখ। এ অবস্থার অবসানে নিজেদের মতো করে গল্প বলতে হবে। আমাদের ছবির গল্প হতে হবে আমাদের জীবনেরই মতো। তা না হলে আমাদের চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাবে।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী
আমাদের চলচ্চিত্র হবে আমাদের ঢংয়ে। আমাদের চারপাশে গল্পের উপাদানের অভাব নেই, নতুন বিষয়ের ঘাটতি নেই। তারপরেও কেন আমরা গতানুগতিক ধারা পরিহার করতে পারছি না। নিজ দেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রতি লক্ষ্য রেখে গল্পের বিন্যাস করলে এই সমস্যা থাকার কথা নয়। তবে কয় বছর আগেও আমাদের চলচ্চিত্রে যে গতানুগতিকতা ছিল এখন সেটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে। নতুন প্রযোজনা সংস্থা, নির্মাতা, গল্প ও অভিনয় শিল্পী আসছে। তারা ভালো করার চেষ্টা করছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে সফলও হচ্ছেন। এভাবে নতুন পথে নতুন আঙ্গিকে না এগোলে দর্শক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করা যাবে না।