এফডিসি পরিণত হয়েছে পঙ্গু প্রতিষ্ঠানে। বছরের পর বছর নানা অনিয়মে চলচ্চিত্র নির্মাণ ক্রমেই কমছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে হচ্ছে ব্যাংক লোন নিয়ে। এফডিসির এই অচলাবস্থার জন্য চলচ্চিত্র বোদ্ধারা দায়ী করছেন সাবেক কয়েকজন এমডিকে। বিশেষ করে ম. হামিদ ও পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সময়ে প্রতিষ্ঠানটি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। এখানে বেশ কিছু চলচ্চিত্র সমিতি থাকলেও চলচ্চিত্রের উন্নয়নের পরিবর্তে চলে দলাদলি। এ কারণে মানসম্মত চলিচ্চত্র নির্মাণ হচ্ছে না। অথচ এফডিসি ছিল শিল্পী-কলাকুশলীদের পদচারণায় মুখরিত একটি পরিবারের মতো। সমিতিগুলোর বিরুদ্ধে ভাড়া ও ইলেকট্রিক বিল পরিশোধ না করারও অভিযোগ রয়েছে। ক্যান্টিন নিয়েও চলে অনিয়ম। এফডিসির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান গাজীপুরে অবস্থিত ফিল্ম সিটি পরিণত হয়েছে গোচারণ ভূমিতে। সদিচ্ছা থাকলে দুই প্রতিষ্ঠান থেকে বিশাল অঙ্কের আয় সম্ভব। অনেকে মনে করেন চলচ্চিত্র অভিজ্ঞদের এমডি হিসেবে নিয়োগ দিলে এই সংকট মোচন হবে। তাদের কথায় এই অচলাবস্থা চলতে থাকলে এফডিসি অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। এ নিয়ে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট বেশ কজন ব্যক্তিত্বের মন্তব্য তুলে ধরা হলো-
মো. মুসা [সাবেক এমডি এফডিসি]
এফডিসি হলো চলচ্চিত্রের উন্নয়ন ও তারকা তৈরির সরকারি প্রতিষ্ঠান। এখানে সরকারি বিধিবিধান মেনে চলতে হবে। কিন্তু সম্প্রতি এফডিসির ভিতরে মিছিল মিটিং করে এফডিসির অ্যাক্ট ভায়োলেট করেছে সমিতি। কিন্তু এখানে তো প্রশাসন রয়েছে। তারপরেও কীভাবে সমিতি এসব কাজ করছে। এফডিসির অভ্যন্তরে আন্দোলন করতে গিয়ে 'টেপ্ট ইন অ্যাবায়েন্স' করেছে সমিতি। এ জন্য তাদের কার্যকলাপ সাময়িকভাবে স্থগিত করা যেতে পারে।
হারুণ অর রশীদ [এমডি, এফডিসি]
১১ মাস আগে এমডি হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে এফডিসির আয় ২৮ লাখ টাকা থেকে ৭১ লাখ টাকায় উন্নীত করেছিলাম। গত তিন মাসে ছবি এন্ট্রি কমে যাওয়ায় এখন আয় ২৫ থেকে ৩০ লাখের বেশি নয়। অথচ সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাসিক বেতনের পরিমাণ প্রায় ৭০ লাখ টাকা। বাকি টাকা ব্যাংকে থাকা এফডিসির এফডিআর থেকে লোন নিয়ে জোগান দেওয়া হচ্ছে। এফডিসির এমডির জন্য এখন কোনো সরকারি গাড়িও নেই। নানা সমস্যার মধ্যে দায়িত্ব নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করছি। কিন্তু ডিসিশন মেকারদের সময় উপযোগী সিদ্ধান্তের অভাবে এখনো পিছিয়ে আছি। এদিকে সমিতিগুলো দীর্ঘদিন ধরে ঘরভাড়া ও ইলেকট্রিক বিল পরিশোধ করে না। কেন্টিনের লিজ দেওয়া নিয়েও নানা জটিলতা আছে। প্রতিবন্ধকতার কারণে গত বৃহস্পতিবার সচিবের কাছে অব্যাহতি চেয়ে পত্র দিলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি।
সোহেল রানা [চলচ্চিত্রকার]
আগেই বলেছি চলচ্চিত্র শিল্প কোমায় চলে গেছে। এখানে চুক্তিভিত্তিকভাবে এমডি নিয়োগ দেওয়া হয়। চলচ্চিত্র বিষয়ে বিজ্ঞদের নিয়োগ দিলে অবস্থার উন্নতি হতো। চলচ্চিত্রের উন্নয়নে দীর্ঘদিন ধরে এফডিসিকে ডিজিটাল করার কথা শুনছি। কিন্তু 'ডিজি' হলেও এখন পর্যন্ত 'টাল'র দেখা মেলেনি। চলচ্চিত্র সমিতিগুলো আসলে পাঠাগার। সেখানে চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজে চলচ্চিত্রকাররা যান। তারপরেও যদি সমিতি অপ্রীতিকর কিছু করে তা হলে প্রশাসন রয়েছে। তাই সমস্যা থাকার কথা নয়।
জুনায়েদ হালিম [চলচ্চিত্র গবেষক]
শিল্প এবং অর্থনীতির সমন্বয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার জন্যই প্রতিষ্ঠানটির জন্ম। এফডিসি সেই লক্ষ্যের ধারে কাছেও কখনো কাজ করেনি। সংস্থাটি পরিচালিত হচ্ছে প্রাইভেট স্টুডিওর মতো। চলচ্চিত্রের উন্নয়নে কাজ না করে শুধু ইকুইপমেন্ট ও ফ্লোর ভাড়া দিচ্ছে। টেকনোলোজি স্থাপন নিয়ে কালক্ষেপণে আমরা আরও পিছিয়ে যাচ্ছি। কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নির্মাতারা নানাভাবে ফায়দা লুটে সংস্থাটিকে পঙ্গু প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। আর এখানে সমিতির অফিস নয়, সংস্থার কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন জাতীয় অফিস থাকতে পারে।
এমডি হয়ে আসে আমলারা। তাদের চলচ্চিত্র সম্পর্কে বোঝার কথা নয়। পরিচালনার নিয়ম বদলাতে হবে। যোগ্য লোক বসাতে হবে।
রোবায়েত ফেরদৌস [ চলচ্চিত্র গবেষক]
এফডিসি হচ্ছে চলচ্চিত্র উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্র। এখানে চলচ্চিত্র সম্পর্কে অভিজ্ঞ লোকদের নিয়োগ দেওয়া দরকার। না হলে প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাহত রোধ করা যাবে না। রাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে গিয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। সত্যিকারের ফিল্ম সিটি হিসেবে এফডিসিকে গড়ে তুলতে হবে। কোনো সমিতির অফিস সরকারি প্রতিষ্ঠানে থাকা উচিত নয়। মোট কথা এফডিসি হতে হবে চলচ্চিত্র উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্র।