'তারিন! ওরে বাবা!!'
অভিনেত্রী তারিন জাহানকে নিয়ে শোবিজপাড়ার মানুষদের অভিব্যক্তি এমনই। সবাই তাকে দেখলে একটু অতিরিক্ত সতর্ক হয়ে যায়। কেউ বিষয়টিকে দেখেন 'ভয়' হিসেবে, কেউ 'সমীহ'। আসলে দ্বিতীয় শব্দটাই যথার্থ। আর এর সঙ্গে মিশে রয়েছে তারিনের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। এই গুণটির কারণেই তারিনের প্রতি সবার সমীহ রয়েছে। সঙ্গে ভালোবাসাও। ভালোবাসা থেকেই 'সমীহ' নামের আবেগটি তৈরি হয়। তার অভিনয় প্রতিভা এবং ব্যক্তিত্ব মিলেমিশে তৈরি হয়েছে সুন্দর এক অভিব্যক্তি।
নুতন কুঁড়ি দিয়ে শুরু। তাই দর্শকের সঙ্গে তারিনের সম্পর্ক কুঁড়িবেলা থেকে। কিন্তু এখন তিনি প্রস্ফুটিত গোলাপ। আর সবাই বুঁদ হয়ে আছে সুবাসে। এই সুবাস অভিনয়ের সুবাস। অন্যদিকে নতুন শিল্পীদের কাছে তিনি অভিনয়ের পাঠশালা। তাকে দেখে অনেকেই শিখছেন অভিনয়ের অ আ ক খ। সঙ্গে ব্যাকরণ মেনেও ঠিক করে নিচ্ছেন নিজের ভুল-ত্রুটি। তাই তারিনের কাছেই প্রশ্ন ছিল, অভিনয় আসলে কি? তিনি উত্তরে বললেন, 'অভিনয় হচ্ছে নিজের সত্তা ভুলে ক্যামেরার সামনে অন্য একটি চরিত্র হয়ে ওঠা। নিজের কল্পনায় দেখা চরিত্রের আবেগ-অনুভূতি, চলন-বলন-আচরণ সূক্ষ্মভাবে ফুটিয়ে তোলা। সঙ্গে নির্মাতার দাবি মেনে চরিত্রকে সঠিক ট্র্যাকে রাখা।'
তারিনের উত্তর শুনে পাল্টা প্রশ্ন- কিন্তু অনেকেই তো অভিনয় করে, সবাই তাহলে চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে পারে না কেন সমানভাবে?
এ প্রশ্নের উত্তরে তারিন কিছুক্ষণ চুপ। নীরবতা। কিন্তু তিনি নীরব না। তার মস্তিষ্ক উত্তর তৈরি করছে। কিছুক্ষণ পর বললেন, 'এ উত্তরের আগে জানতে হবে শিল্পী কাকে বলে। প্রতিটি শিল্পী ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে ভাবে। সবার শিল্পীসত্তা আলাদা। তাই ভাবনাও আলাদা। আমি যেভাবে একটি চরিত্র নিয়ে ভাবি, অন্য শিল্পী নিশ্চয়ই সেভাবে ভাববে না। তাই একই চরিত্র শিল্পী ভেদে ভিন্ন ভিন্ন রূপায়ন হবে। যেমন ধরুন অনেক শিল্পীই নদীর ছবি এঁকেছে। কিন্তু সব নদী দেখতে একই রকম হয়নি। যার যার দেখার ভঙ্গি ভিন্ন হওয়ার কারণেই নদীগুলো ভিন্ন ভিন্ন হয়েছে।'
তারিনের অভিনয় দেখে নতুন প্রজন্মের অভিনেত্রীরা শিখছেন। ঠিক তারিনও এক সময় অগ্রজের কাছ থেকে শিখেছেন। তাই তো সুবর্ণা মুস্তাফাদের মতো অভিনেত্রীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক যথেষ্ট আন্তরিক। কিন্তু নতুন প্রজন্মের অভিনেত্রীদের সঙ্গে তারিনের সম্পর্ক কেমন! তিনি নিজেই বললেন, 'অনেকের সঙ্গেই আমার ভালো সম্পর্ক। অনেকেই খুব ভালো অভিনয় করে। মনোযোগী নিজের অভিনয় প্রতিভা বিকশিত করতে। আমি এমন নাম অনেক বলতে পারব।'
তারিন এক সময় প্রচুর নাটকে অভিনয় করতেন। কিন্তু বর্তমানে তাকে একটু কম দেখা যায়। বিভিন্ন উৎসব-পার্বণ কেন্দ্রিক নাটকগুলোতেই তিনি অভিনয় করেন বেশি। কি কারণ? তারিন বললেন, 'এখন অনেক বেশি চুজি আমি। অনেক ভেবে অভিনয় করি। ভালো পাণ্ডুলিপির সংখ্যা কমে গেছে। তাই আমার অভিনয়ও কমে গেছে। অভিনয়ের মূল বিষয়ই একটা ভালো পাণ্ডুলিপি এবং একটি সুন্দর চরিত্র। কিন্তু বর্তমান চিত্রটা কি? তবে উৎসব-পার্বণের নাটকগুলো যত্দ নিয়ে নির্মাণ করা হয়। গল্পগুলোও ভালো থাকে। তাই ওই সময়ে অভিনয়েও ব্যস্ততা বেড়ে যায়।'
ভালো পাণ্ডুলিপি এবং ভালো নাটকের সংখ্যা কমে যাওয়ার জন্য তারিন মূলত দায়ী করেছেন লাগামহীন চ্যানেলের সংখ্যা। যে পরিমাণ চ্যানেল বেড়েছে, সে তুলনায় মেধাবী শিল্পী বাড়েনি। তাই অনেক নিম্নমানের নাটক প্রচার হচ্ছে। তিনি বলেন, 'আমাদের স্টকে কি পরিমাণ মেধাবী নাট্যকার-নির্মাতা আছে, তার একটা ধারণা থাকা উচিত। সে অনুযায়ী নাটক নির্মাণ করলে আমাদের ঐতিহ্য ঠিক থাকবে। সব চ্যানেলেই অনেক অনেক নাটক প্রচার হতে হবে কেন! নাটকের বাইরেও তো প্রচুর ননফিকশন অনুষ্ঠান প্রচার করা যায়। সবারই মনে রাখা উচিত, আমরা ভালো নাটকের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু সেই সুনাম আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এখনই ঘুরে না দাঁড়ালে সব শেষ হয়ে যাবে।'
তারিনের বিরক্তির আরও একটি জায়গা আছে। সেটি বিজ্ঞাপন বিরতি। লাগামহীনভাবে বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে। দর্শক বিরক্ত হয়ে হিন্দি সিরিয়ালে বিনোদন খুঁজছে। তিনি বলেন, 'দর্শক কি ইচ্ছে করে নিজেদের নাটক রেখে হিন্দি সিরিয়াল দেখছে! না। তারা বাধ্য হচ্ছে। আমরা নানাভাবে পথ হারাচ্ছি। অন্ধকারে পথ চলছি। আলো ফেলে সুন্দরভাবে পথ চলা যায় ভুলেই গেছি।' তিনি এ বিষয়ে 'সোনার ডিম পাড়া হাঁস'র গল্পটি স্মরণ করিয়ে দেন। বিজ্ঞাপন প্রচার করে চ্যানেল মুনাফা করছে। যত বিজ্ঞাপন ততো মুনাফা। কিন্তু যখন দর্শকই থাকবে না তখন কে বিজ্ঞাপন দেবে! তাই আগে দর্শক ধরে রাখতে হবে, তাহলে মুনাফা এমনিতেই আসবে। কিন্তু আমাদের চ্যানেলগুলোর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, তারা ম্যারাথন দৌড়ে বিশ্বাসী নন।
অনেক কঠিন কঠিন বিষয় নিয়ে তারিনের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হলো। এবার সহজ বিষয়ে আসা যাক। সেটা তারিনের ব্যক্তিজীবন। যে জীবনে তিনি বাতাসের মতো সরল, নদীর মতো টলটলে। তারিন বয়সে পরিপক্ব। কিন্তু মনের মধ্যে এখনো শিশুসুলভ একটা জগৎ আছে। তাই সবাইকে নিয়ে এখনো প্রচুর হৈহুল্লোড় করেন। ঘুরে বেড়ান যেখানে মন চায়। এই তো কিছুদিন আগে ঘুরে এলেন মার্কিন মুল্লুক থেকে। সেখানে স্বজনদের সঙ্গে সুন্দর সময় কাটিয়েছেন। কিন্তু মাঝে বিপত্তি এসেছিল। তার প্রাণপ্রিয় মা অসুস্থ হয়েছিলেন। তারিন সবার কাছে দোয়া চেয়ে স্ট্যাটাসও দিয়েছিলেন ফেসবুকে। সবার প্রার্থনায় তার মা এখন সুস্থ। তাই প্রজাপতির মতো তারিনও মনের সুখে ঘুরে বেড়িয়েছেন। বুক ভরে বিশুদ্ধ বাতাস নিয়ে নিজেকে সতেজ করে দেশে ফিরেছেন। ফিরেই আবার ক্যামেরার সামনে বিভিন্ন চরিত্র হয়ে উঠছেন।
প্রতিটি মানুষেরই শুভাকাঙ্ক্ষী-স্বজন থাকে। তবুও মানুষের জীবনে প্রয়োজন একান্ত আপন কেউ। তার নাম জীবনসঙ্গী। কিন্তু তারিনের ভাবনা এ বিষয়ে কি! জীবনসঙ্গী কবে হবে! তার ভক্তদেরও এমন প্রশ্ন মনে মনে। তাই তারিনের কাছে ইনিয়ে বিনিয়ে জানতে চাওয়া হলো। প্রশ্নটা ইনিয়ে বিনিয়ে করা হলেও তারিন উত্তর দিলেন স্বভাবসুলভ সোজাসাপ্টা ভঙ্গিতে। তিনি বললেন, 'ওপরওয়ালা ভাগ্য যেভাবে লিখেছেন ঘটনাটি সেভাবেই ঘটবে। এ নিয়ে আমার বিশেষ কোনো ভাবনা নেই। কারণ বিষয়টা ভাবার জন্য আমার স্বজনরাই যথেষ্ট।'