যৌথ প্রযোজনার ব্যয়বহুল চলচ্চিত্র ‘ডুব’। নির্মাণ শেষে মুক্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ছবির পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। কিন্তু বৃহস্পতিবার তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে থমকে গেছে চলচ্চিত্রটির যাত্রা।
এর আগে অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন হুমায়ূন আহমেদের জীবনের কিছু ঘটনাকে ভুলভাবে উপস্থাপনের আশঙ্কা জানিয়ে সেন্সর বোর্ডকে চিঠি দিয়েছিলেন। তথ্য মন্ত্রণালয়ের এই স্থগিতাদেশ মানে পরবর্তী আদেশ পাওয়ার আগে এখন আর ছবিটি সেন্সর বোর্ডেও জমা দেওয়া যাবে না।
ইতোমধ্যে 'ডুব' ছবি নিয়ে নানা রকম গুঞ্জন উচ্চারিত হচ্ছে। এদিকে এসব বিষয়কে মাথায় রেখে আজ রবিবার নিজ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন করেছেন মেহের আফরোজ শাওন।
তিনি বলেন, গত বছরের শেষ দিকে ভারতের একটি প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যম ‘আনন্দ বাজার’-এর কাছ থেকে প্রথম ‘ডুব’ ছবিটির পটভূমি সম্পর্কে জানতে পারি। আমাকে জানানো হয়, ছবিটি হুমায়ুন আহমেদের জীবনকে ঘিরে এবং হুমায়ুন পরিবারের কিছু সদস্যের চরিত্রও ছবিটিতে উঠে এসেছে যার মধ্যে আমিও আছি। খবরটি আমাকে বিস্মিত করে। তার পরপরই বাংলাদেশ এবং ভারতের প্রধান প্রধান সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্ট থেকে জানতে পারি যে আলোচ্য ছবিটি কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের জীবনের কিছু স্পর্শকাতর ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে।
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় ছবির মূল চরিত্রে অভিনয়শিল্পী ইরফান ভান শ্যুটিংয়ের আগে হুমায়ুন আহমেদের প্রচুর ভিডিও দেখেছিলেন এবং সেগুলো দেখেই হুমায়ুন আহমেদের কথাবার্তা বলার ধরন— এসব নিয়ে হোমওয়ার্ক করেছিলেন। ছবির আরেক অভিনয়শিল্পী পার্নো মিত্র তার ফেসবুক পেজে দেওয়া স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেন যে, তার অভিনীত চরিত্রের নাম ‘মেহের আফরোজ শাওন (যদিও কিছুক্ষণ পর তা সম্পাদনা করে বাদ দেন।)
সঙ্গত কারণেই আমি আশঙ্কা বোধ করি, কেননা ছবিটির পরিচালক তার কোনো মন্তব্যেই ছবিটির সঙ্গে হুমায়ুন আহমেদের জীবনের সম্পৃক্ততার কথা স্পষ্ট করে অস্বীকার করেননি।
আমার আশঙ্কা আরও প্রবল হয় যখন ডুব ছবির অভিনয় শিল্পী রোকেয়া প্রাচী তার সাক্ষাত্কারে স্পষ্ট করে বলেন যে, ‘ডুব’ হুমায়ুন আহমেদেরই জীবন কাহিনী। তার সাক্ষাত্কার থেকে ছবির কাহিনীর যে সার সংক্ষেপ জানা যায়, তা হুমায়ুন আহমেদের জীবনের কিছু বিতর্কিত অংশ আর সত্যতা নিয়ে বিভ্রান্তি করছে।
হুমায়ুন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের তথা বাংলাদেশের একজন কিংবদন্তি লেখক। তিনি আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার মানে কি এই যে তাকে নিয়ে একটি মনগড়া কাহিনীচিত্র বানিয়ে ফেলা যায়। ‘হুমায়ুন আহমেদ’ নাম বদলে চরিত্রের অন্য যে নামেই দেওয়া হোক সেই চরিত্র হয় বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় লেখকের যিনি চলচ্চিত্র নির্মাণও করেন, সংসার জীবনে যার দুটি অধ্যয় আছে এবং ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে যার জীবনাবসান হয়েছে, সেটি কার জীবন সেটি বুঝতে কোনো দর্শকের প্রয়োজন পড়ে না।
তার জীবনের অনেক কথাই পাঠক দর্শকের জানা। সেই সত্য গল্পে সঙ্গে কিছু বিভ্রান্তিমূলক তথ্য এবং তাকে নিয়ে ট্যাবলয়েড পত্রিকায় কিছু চটকদার গুজব জুড়ে দিয়ে যদি কোনও ছবি বানানো হয় সেটা কি নৈতিক?
চলচ্চিত্র একটি শক্তিশালী মাধ্যম। দর্শকের মধ্যে অনেক হুমায়ুন ভক্ত আছেন। নতুন প্রজন্মের এমন অনেক দর্শক আছেন, যারা হুমায়ুন আহমেদ পড়া শুরু করেছে মাত্র। তারা ছবিটি দেখে ভুল তথ্য পাবেন হুমায়ুন আহমেদকে নিয়ে এবং এই বিভ্রান্তিকর তথ্যে ভরা কাহিনীচিত্রটি পরিবর্তিতে হুমায়ুন আহমেদের জীবনী হিসেবে ভবিষ্যত্ প্রজন্মের কাছে উপস্থাপিত হবে। হুমায়ুন এবং আমার দুটি ছোট সন্তান আছে। তাদেরও ভবিষ্যত আছে। বিভ্রান্তিমূলক তথ্যের মধ্যে তারা কেন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়বে! এসব বিবেচনায় হুমায়ুন আহমেদের জীবন নিয়ে নির্মিত সিনেমা নিয়ে আমার আশঙ্কা করার যথেষ্ট কারণ আছে।
সেই আশঙ্কা থেকেই ফেব্রুয়ারি ১৩ তারিখে আমি একটি চিঠি সেন্সরবোর্ডে দেই। চিঠিতে অনুরোধ করা হয়, আমি যেই আশঙ্কাগুলো করছি, ছবিটি দেখার সময় সেই বিষয়গুলো যাচাই বাছাই করে যেন তারা সিদ্ধান্তে উপনীত হন। এ ছবিতে যদি কোনো আপত্তিকর বিষয় থাকে, সেগুলো যেন যথাযথভাবে পরিবর্তন এবং পরিশোধন করে মুক্তি দেওয়া হয়।
আমি নিজেও একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা। কোনো নির্মাতা বা তার নির্মাণের সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই। আমি কোনো চলচ্চিত্র নিষিদ্ধের কথাও বলিনি। কিন্তু হুমায়ুনের স্ত্রী হিসেবে এবং তার একজন ভক্ত পাঠক হিসেবে হুমায়ুন আহমেদকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা কোনো চলচ্চিত্রের পক্ষে আমার অবস্থান থাকবে না এটাই স্বাভাবিক।
বিডি প্রতিদিন/১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/এনায়েত করিম