১৯৯৭ সালের আইএমএফ সংকট দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। এই সংকট অসংখ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছিল, বেকারত্ব আকাশ ছুঁয়েছিল এবং মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জীবন রাতারাতি ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। অভিনেতা লি জে হুনের জন্য এটি কেবল ইতিহাসের একটি অংশ ছিল না; এটি তাঁর নিজের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
গত ২ জুন, লি জে হুনের নতুন চলচ্চিত্র "বিগ ডিল"-এর প্রচারণার জন্য একটি সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে তিনি অকপটে তুলে ধরেন কীভাবে ১৯৯৭ সালের ঘটনাপ্রবাহ তাঁর শৈশবকে বিঘ্নিত করেছিল এবং তাঁর জীবনের গতিপথ বদলে দিয়েছিল। কাকতালীয়ভাবে, চলচ্চিত্রটির বিষয়বস্তু (যা দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক পতনের সময়কে চিত্রিত করে) লি জে হুনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত।
লি জে হুনের পারিবারিক বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণ
নিজের ছোটবেলার কথা স্মরণ করে লি জে হুন জানান, অর্থনৈতিক সংকট যখন আঘাত হানে, তখন তিনি জুনিয়র হাই স্কুলে পড়তেন। সে সময় তাঁর পরিবারের দুটি ছোট ব্যবসা ছিলো। একটি চালের দোকান এবং একটি রেস্তোরাঁ। এগুলো সাধারণ হলেও স্থিতিশীল উদ্যোগ ছিল যা তাদের স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন বজায় রাখতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু সেই সময়ের অসংখ্য ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মতোই বিপর্যয় দ্রুত এবং নির্মমভাবে নেমে আসে। তাঁর পরিবারের ব্যবসাগুলো অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলাতে পারেনি এবং তারা বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য হয়।
লি জে হুনের জন্য সবচেয়ে বেদনাদায়ক মুহূর্ত ছিল তার বাবাকে দিনমজুরি করতে দেখা। যা তাদের সংসার চালাতে সাহায্য করছিল। একজন কিশোরের জন্য এটি ছিল অত্যন্ত কঠোর অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, তখনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম পরিস্থিতি কতটা কঠিন হয়ে উঠেছে।
বায়োটেকনোলজি থেকে বড় পর্দায়
সংকট মারাত্মক দুর্ভোগ বয়ে আনলেও এটি লি জে হুনকে তার বয়সের চেয়ে বেশি মানসিক পরিপক্কতা দান করে। তিনি কেবল তার পরিবারের কষ্টই দেখেননি, একটি জাতির সম্মিলিত বেদনাও প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ছোট ছোট দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রতিবেশীরা চাকরি হারিয়েছিল। যারা একসময় স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতেন, তাদের সবকিছু নতুন করে ভাবতে হয়েছিল।
আকর্ষণীয়ভাবে লি জে হুন তার প্রাপ্তবয়স্ক জীবন অভিনয়ের পথে শুরু করেননি। তিনি প্রাথমিকভাবে কোরিয়া ইউনিভার্সিটিতে বায়োটেকনোলজির ছাত্র হিসেবে ভর্তি হয়েছিলেন, যা একাডেমিক স্থিতিশীলতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু অভিনয়ের প্রতি তাঁর আকাঙ্ক্ষা তাঁকে সেই প্রচলিত পথ ত্যাগ করতে প্ররোচিত করে। পরে তিনি কোরিয়া ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ আর্টসে স্থানান্তরিত হন, যেখানে তিনি নাট্যকলা অধ্যয়ন করেন। পরবর্তী দুই দশকে লি জে হুন ইন্ডিপেন্ডেন্ট চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে মূলধারার ব্লকবাস্টার এবং সমালোচকদের প্রশংসিত ড্রামাং কাজ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
“বিগ ডিল” একটি পূর্ণাঙ্গ বৃত্তের মুহূর্ত
লি জে হুনের জন্য "বিগ ডিল"-এ কাজ করা কেবল আরেকটি অভিনয় প্রকল্প নয়। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ বৃত্তের মুহূর্তের মতো। তিনি বলেন, আমি আসলে আইএমএফ সংকটের সময় একটি কঠিন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলাম, তাই এই গল্পটি বলা আমার কাছে অর্থপূর্ণ ছিল।
"বিগ ডিল" ১৯৯৭ সালের বিশৃঙ্খল আর্থিক পরিস্থিতিতে নির্মিত। চলচ্চিত্রটি কোরিয়ার জাতীয় সোজু শিল্পের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুটি পেশাদারের মধ্যে উচ্চ-দরের সংগ্রামের উপর আলোকপাত করে। যদিও চরিত্রগুলি কাল্পনিক, তবে পটভূমিটি ঐতিহাসিক।
"বিগ ডিল" লি জে হুনের জন্য শুধু একটি চলচ্চিত্র নয় বরং তাঁর জীবনের এক কঠিন অধ্যায়ের প্রতিচ্ছবি। এই চলচ্চিত্রটি দর্শকদের সেই সময়ের ভয়াবহতা এবং তার প্রভাব সম্পর্কে একটি গভীর অন্তর্দৃষ্টি দেবে, যা লি জে হুনের মতো অসংখ্য দক্ষিণ কোরিয়ানের জীবনে অমোচনীয় ছাপ ফেলেছিল। এই চলচ্চিত্রটি লি জে হুনের ব্যক্তিগত যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে তিনি তাঁর অতীতকে শিল্পের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত করেছেন।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল