১৩ মে, ২০১৯ ১৭:৩০

'ঘটনার আকস্মিকতায় একখণ্ড আবেগ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম'

রিমি রুম্মান

'ঘটনার আকস্মিকতায় একখণ্ড আবেগ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম'

নিউইয়র্ক সিটির স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা সফরে নিয়ে যাওয়া হয় ক'দিন পরপরই। কখনো মিউজিয়াম, কখনো চিড়িয়াখানায়। আবার কখনো বা মুভি থিয়েটারে। চাইলে মায়েরাও যেতে পারে সাথে। আমার কখনোই যাওয়া হয়নি।  এবার ফেব্রুয়ারিতে আমার আট বছর বয়সী বাপজান রিহান তার সাথে যেতে আবদার করলো। জানতে চাইলাম, কেন? বলল, ওইদিন তোমার জন্মদিন। আমি আমার সহপাঠীদের সবাইকে বলবো এ কথা। তারপর সবাই মিলে তোমাকে উইশ করবো। আমি হাসলাম। তাকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জানালাম। নির্দিষ্ট দিনে সব বেমালুম ভুলে গেলাম। ঘটা করে জন্মদিন পালন করার মতো পরিবারে জন্মাইনি কি না! তাই এইসব বিশেষ দিন বিশেষভাবে মনে রাখা দুরহ হয়ে উঠে। 

সেদিন ছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি। চমৎকার ঝকঝকে একটি দিন। মাথার উপর ভরদুপুরের নিরুত্তাপ রৌদ্র। স্কুল ছুটির সময়।  স্কুলের বিশাল প্লে গ্রাউন্ডে প্রতিটি ক্লাসের শিক্ষকরা সারিবদ্ধভাবে তাদের শিক্ষার্থীদের নিয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যপাশে শত শত অভিভাবক অপেক্ষায়। আমি হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে অভিভাবকদের কাতারে গিয়ে দাঁড়ালাম। আচমকা রিহানের ক্লাস ৩০৬ এর শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা একযোগে 'হ্যাপি বার্থ ডে' গান গেয়ে উঠলো। শত শত শিক্ষক, ছাত্র এবং অভিভাবকের মনোযোগ সেইদিকে। 

ঘটনার আকস্মিকতায় পৃথিবীর সবচাইতে তীব্র বিস্ময় নিয়ে একখণ্ড আবেগ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। শ্রেণি শিক্ষক এগিয়ে এলেন। কিছু ফুল হাতে দিয়ে বললেন, রিহান আজ আমাদের সবাইকে তার মায়ের জন্মদিনের কথা জানিয়েছে।  সে খুব মনে প্রাণে চেয়েছে আমরা সবাই মিলে তোমায় শুভেচ্ছা জানাই। আমরা তার চাওয়াকে সম্মান জানিয়েছি মাত্র।  বাড়ি ফিরবার পথে রিহানের 'তুমি হ্যাপি হইসো, আম্মু' এমন বিরামহীন প্রশ্নে দু'চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল। ভেতরে অহর্নিশ বেজে চলছিল নানান দেশ আর নানান ধর্মের শিশুদের কণ্ঠে একযোগে গেয়ে উঠা হ্যাপি বার্থ ডে গান। মাকে এমন করে চমকে দেয়ার এই বুদ্ধি কোথা থেকে পেলো এতোটুকুন মানুষটি! 

মা দিবস ছিল আজ এই শহরে। বৃষ্টিস্নাত শহর, তবুও পথে পথে ফুল কেনাবেচার হিড়িক। মনে পড়ছিল প্রথম মা হবার সময়কার কথা। রাত দুটো থেকে পরদিন দুপুর প্রায় ১২টা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় লেবার পেইনের সাথে যুদ্ধ করে করে ক্লান্ত আমি টের পাই আচমকা চারপাশের ডাক্তার, নার্স সকলে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। আমার স্বামীকেও নীল রং এর ইউনিফর্ম, মাস্ক পরালেন দ্রুত। আমাকে অপারেশন থিয়েটারের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঝড়ের গতিতে। তীব্র ব্যথায় ছটফট করতে করতে সকলের মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। কানের কাছে মুখ এনে একজন বললেন, বেবির হার্ট বিট ধীর গতিতে হচ্ছে। জীবনে প্রথম মা হতে যাওয়া আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমার সন্তান সম্ভবত মারা যাচ্ছে। 

আমার দু'চোখের কোল বেয়ে অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিলো হাসপাতালের সাদা বিছানায়। আমি অপার্থিব এক অন্ধকারে তলিয়ে যেতে লাগলাম। চোখ বন্ধ করে স্রষ্টাকে স্মরণ করলাম। মা'কে স্মরণ করলাম। মনে প্রাণে নিজের সন্তানের জীবন ভিক্ষা চাইলাম, নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও। সৃষ্টিকর্তা সম্ভবত অতটা নিষ্ঠুর হতে পারেননি।  আমাদের দু'জনকেই বাঁচিয়ে রাখলেন। পৃথিবীর বুকে নতুন করে শ্বাস নিলাম আমি এবং আমার আত্মজ। তখন ঘড়িতে নিউইয়র্ক সময় বেলা ১২টা ১২। জগতের সকল মায়ের জন্য ভালোবাসা। 

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর