১৭ জানুয়ারি, ২০২১ ১৫:৪৮

শিরোনাম পড়েই এই জনপদে বিজ্ঞানী, গবেষক হয়ে যাওয়া যাচ্ছে

আমিনুল ইসলাম

শিরোনাম পড়েই এই জনপদে বিজ্ঞানী, গবেষক হয়ে যাওয়া যাচ্ছে

আমিনুল ইসলাম

দেশের নামকরা বুদ্ধিজীবী এবং কর্তা-ব্যক্তি'রা নিজেদের মাঝে কথা বলছেন। সেই আলোচনায় আমিও উপস্থিত আছি। এদের একজন আমার দিকে তাকিয়ে বলে বসলেন

- সমাজ বিজ্ঞান একটা সাব্জেক্ট হলো! এটা তো যে কেউ পড়তে পারে। আলাদা করে এইসব পড়ার মানে কি? 

আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম এবং মনে মনে ভাবলাম - ইনি হচ্ছেন দেশের নামকরা বুদ্ধিজীবী! তাকে আর উত্তর কি দেব, উল্টো বলে বসলাম 
- হ্যাঁ, আপনি আসলে ঠিক'ই বলেছেন। এইসব পড়ে কোন ফায়দা নেই! 

এরপর আশপাশের সবাই গভীর আগ্রহের সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা করছিল- কেন এইসব পড়তে হবে! কি দরকার এইসব পড়ে! 

এরও প্রায় এক যুগ আগে, আমি তখন দেশে ফিরে ঢাকার একটা নামকরা বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি'তে শিক্ষকতা করছি। সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে; আমরা দুইজন শিক্ষক ডিউটি দিচ্ছি। তো, আমার ওই সহকর্মী বুয়েট থেকে পাশ করা ইঞ্জিনিয়ারিং এর শিক্ষক। তিনি আমাকে বলে বসলেন 

- আপনি এতো সাবজেক্ট থাকতে সমাজ বিজ্ঞান পড়লেন কেন?

প্রশ্ন শুনেই আমার আর বুঝতে বাকী থাকলো না; তাঁর উদ্দেশ্য আসলে কি! 

আমি উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। তিনি এরপর বললেন 

- আসলে এইসব সাবজেক্ট পড়ার তো কোন মানে নেই। তাই জিজ্ঞেস করলাম। 

আমি আর ভদ্রলোক'কে কোন উত্তর দেইনি। কারন আমি জানি- তাঁর উদ্দেশ্য'ই ছিল আমাকে ছোট করা। ঠিক যেমনটা সমাজের নামি-দামী বুদ্ধিজীবিরা তাদের আলোচনায় আমাকে ছোট করে মজা পাচ্ছিলেন। 

সমাজ বিজ্ঞান কেন পড়তে হবে; এই লেখায় আমি সেই ব্যাখ্যা দেব না। তার চাইতে বরং একটা উদাহরণ দেই। 

গতকাল আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়া জো বাইডেন তাঁর সায়েন্স এডভাইজর অর্থাৎ বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টা'দের নাম ঘোষণা করেছেন। এই কমিটি'তে ডেপুটি চিফ হিসেবে যিনি মনোনীত হয়েছেন, তাঁর নাম হচ্ছে- এলন্ড্রা নেলসন। তিনি একজন সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং গবেষক। তিনি গবেষণা করেন সমাজ এবং প্রযুক্তি নিয়ে। সেই সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। তাঁর লেখা শেষ বইটির নাম- সোশ্যাল লাইফ অফ ডিএনএ। 

সমাজ এবং প্রযুক্তি কিভাবে অসমতা তৈরি করে এই নিয়ে তিনি লিখে যাচ্ছেন। এখন বাংলাদেশের ওই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এবং ইঞ্জিনিয়ার'দের কারো কি প্রশ্ন করা উচিত না 

- এই ভদ্রমহিলা সমাজ বিজ্ঞান পড়িয়ে কি করে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টা হয়ে যান? আমরা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার'রা কি দোষ করলাম! 

যেই দেশে মানুষ এখনও চাঁদে মানুষ দেখতে পায়! যেই দেশে মানুষ এখনও বিশ্বাস করে- ছেলে ধরা বাচ্চা ছেলে'দের মাথা কেটে ব্রিজ তৈরি করার জন্য সাপ্লাই দেয়! যেই দেশের মানুষজন এখনও বিশ্বাস করে- হিটলার মরে নাই। এন্টারকটিক নামক মহাদেশের তলদেশে লুকিয়ে আছে! যেই দেশের মানুষজন এখনও ডানে গেলে দোষ! বামে গেলে দোষ! সামনে হাঁটলে দোষ! পেছনে হাঁটলে দোষ! এইসব সংস্কারে আসক্ত! 
সেই দেশের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এবং কর্তা ব্যক্তি'রা জিজ্ঞেস করে বসেন - সমাজ বিজ্ঞান পড়ে ফায়দা কি? 

আর যেই দেশে এর মাঝেই  চাঁদে গিয়েছে। যেই দেশ দুই দিন পর পর'ই মঙ্গল গ্রহে অভিজাত্রা করছে। যেই দেশ চিন্তা করছে কিভাবে স্পেসে মানুষের বসতি গড়ে তোলা যায়! সেই দেশের প্রেসিডেন্ট তাঁর বিজ্ঞান উপদেষ্টা হিসেবে একজন সমাজ বিজ্ঞানী'কে বেছে নিয়েছেন। আর আমরা বাংলাদেশিরা? 

আমরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা বড় কর্তা ব্যক্তি হয়ে কিভাবে অন্যকে ছোট করা আনন্দ পাওয়া যায়; সেই চেষ্টা করে বেড়াচ্ছি! 

এই যে অন্যকে ছোট করে আমরা মজা পাই; কেন পাই? এর পেছনে কারনটা কি? এটা জানা এবং বুঝার জন্যও সমাজ বিজ্ঞান পড়া দরকার। এটা এদেরকে কে বুঝাবে! 

অবশ্য যাদের বুঝানোর কথা; সেই শিক্ষকরা কি আদৌ নিজেরা কোন গবেষণা করছেন? 

উনারা তো ব্যস্ত রাজনীতি নিয়ে আর টেলিভিশনে গিয়ে নিজেদের দলের হয়ে সাফাই গাইতে। পড়াশুনা কিংবা গবেষণার ধারে কাছেও আমরা নেই! 
পড়াশুনা? সামান্য একটু বড় লেখা হলেই তো আমরা পড়ি না! 

একটা উদাহরণ দেই- কিছুদিন আগে আমেরিকার নির্বাচনের সময় আমি একটা কলাম লিখলাম পত্রিকায়। সেখানে লিখলাম- আমেরিকানরা দিনশেষে ট্রাম্প'কেই নির্বাচিত করবে। 

এটা ছিল আমার লেখার শিরোনাম। তো, সেই লেখা আমি আমার ফেসবুকে পোস্ট করেছি। নির্বাচনের পর যখন বাইডেন জিতে গেল; আমি আনন্দিত হয়ে লিখলাম- অভিনন্দন জো বাইডেন। 

একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সেখানে এসে মন্তব্য করেছেন 
- আপনি তো দেখি পুরোই ভোল পাল্টে ফেলেছেন। নির্বাচনের আগে বলেছেন ট্রাম্প জিতবে। এখন বাইডেন'কে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। 

এর মানে দাঁড়াচ্ছে- আমার আগের লেখাটা সে পড়েই নাই! শুধু শিরোনাম দেখে মহা আনন্দে মন্তব্য করতে চলে এসছে! 

ওই লেখায় আমি লিখেছিলাম- আমার অনুমান যদি ভুল প্রমাণিত হয়, আমি'ই সব চাইতে বেশি খুশি হবো। ভদ্রলোকের পুরো লেখা পড়ার সময় হয়নি। তিনি শিরোনাম পড়েই মহা আনন্দে মন্তব্য করতে চলে এসছেন! 

শিরোনাম পড়েই এই জনপদে বিজ্ঞানী, গবেষক কিংবা বিশিষ্ট কর্তা ব্যক্তি হয়ে যাওয়া যাচ্ছে। অন্য আর কিছু জানার কিংবা পড়ার দরকার হচ্ছে না! 

এরপর বিজ্ঞানী হয়ে গিয়ে আমরা মহাআনন্দে অন্যকে ছোট করে বেড়াই! 

এ এক মজার সাইকেল। কেবল ঘুরতেই থাকে!

 

বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর