'হিলেল্লা মিলেবো জুমত যায় দে, জুমত যায় দে, যাদে যাদে পধত্তুন পিছ্যা ফিরি রিনি চায়, শস্য ফুলুন দেঘিনে বুক্কো তার জুড়ায়...' এটি চাকমা সম্প্রদায়ের জনপ্রিয় একটি গান। এ গানের বাংলা অর্থ হল, 'পাহাড়ি মেয়েটি জুমে যায় রে, জুমে যায় রে, যেতে যেতে পথে পিছন ফিরে চায়, পাকা শস্য দেখে তার বুকটা জুড়ায়।' জুম ক্ষেতেভরা সবুজ পাহাড় দেখে জুম ঘরের মাচায় বসে গানের সুর সুরে মেতে ওঠে তরুণ-তরুণীরা। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও বাঙালীদের ঐতিহ্যবাহী চাষ হচ্ছে জুম চাষ (পাহাড়ের ঢালে বিশেষ ধরনের চাষাবাদ)। জুমিয়ারা পাহাড়ের ঢালে বিশেষ পদ্ধতির এই আদি জুম চাষ করে থাকে।
পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়ি মানুষের জীবিকার আদিম ও প্রধান উৎস জুম চাষ। বাংলাদেশের একমাত্র তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে এ জুম চাষ করা হয়। এখন জুমের পাহাড় সবুজ ধান গাছে ভরপুর। এটা পার্বত্যাঞ্চলে জুম চাষ করার ভর মৌসুম। জুম্ম নারীরা উৎফুল্ল মনে ব্যস্ত জুম চাষে। সারা বছরের পরিশ্রম শেষে ফলানো ফসল দেখে জুমিয়া নারী-পুরুষের মুখে ফুটেছে হাসি।
তিনটি পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের পাহাড়িদের জুম ক্ষেতে সবেমাত্র শুরু হয়েছে পাকা ধানকাটা। ধুম পড়েছে মারফা, বেগুন, ধানি মরিচ, ঢেঁড়শ, কাকরোল, কুমড়াসহ বিভিন্ন ফসল তোলার কাজ। এরপর ঘরে উঠবে তিল, যব এবং সবশেষে তোলা হবে তুলা। এ মৌসুমে উপযুক্ত জলবায়ু ও বৃষ্টিপাতের কারণে এবং ইঁদুরের উৎপাত কমে যাওয়ায় ভালো ফলন হয়েছে। জুমের সোনালি ফসল ঘরে তুলতে পারায় জুম্ম নারী-পুরুষ ফিরে পেয়েছে মুখের হাসি। চোখে ফুটে উঠেছে আশার আলো। জুমে বীজ বপনের ৬ মাস পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের পর ফসল পাওয়া যায়।
পাহাড়ের জুমচাষী শ্যামলী চাকমা বলেন, জুমিয়ারা পৌষ-মাঘ মাসে পাহাড়ের ঢালে জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে রৌদ্রে শুকানোর পর ফাল্গুন-চৈত্র মাসে আগুনে পুড়িয়ে জুম চাষের উপযোগী করে তুলে। এরপর বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে পোড়া জুমের মাটিতে সূঁচালো দা দিয়ে গর্ত খুঁড়ে একসঙ্গে ধান, মারফা, মিষ্টি কুমড়া, তুলা, তিল, ভুট্টাসহ বিভিন্ন রকম বীজ বপন করে থাকে। আর এসব জুমের ধান আষাঢ়-শ্রাবণ মাসেই পেকে থাকে। তারপর শুরু হয় জুমের ফসল তোলার কাজ । সে সময় মারফা, কাঁচামরিচ, চিনার, ভুট্টা পাওয়া যায়। ধান পাকে ভাদ্র-আশ্বিন মাসে। সবশেষে তুলা, তিল, যব ঘরে তোলা হয় কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে। আগের পর পর কয়েক বছর খরায় এবং বৃষ্টিপাতের অভাবে জুমচাষ হয়নি। এবছর কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টিপাতের ফলে সময়মতো জুম চাষ সম্ভব হয়েছে। জুমে ইদুঁর ও অন্যান্য পোকামাকড়ের উপদ্রব না থাকালে ফলনও বাম্পার হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
এদিকে, পার্বত্য তিনটি জেলায় প্রতি বছর কত একর জায়গায় জুম চাষ হয় তার সঠিক পরিসংখ্যান জানা যায়নি। রাঙামাটি জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা সূর্য কুমার চাকমা জানান, এবছর রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় এ বছর ৬ হাজার ৩৮৫ হেক্টর জমিতে জুম চাষ করা হয়েছে। সবেমাত্র জুম চাষ করা হয়েছে মোটামুটি চারাগুলো বড় হয়েছে। তবে ধান পাকে ভাদ্র-আশ্বিন মাসে। পুরোপুরি ফলন পেতে ছায়মাস অপেক্ষা করতে হবে। জুমে ৩০ থেকে ৩৫ প্রকার ফলফলাদির চাষ হয়ে থাকে। এজন্য জুমচাষকে একটি খাদ্য ব্যাংক ধরা হয়। এসব জুমে এবারের আবহাওয়া অনুকূলে থাকালে ও সঠিক বৃষ্টিপাত হলে জুমের ফলন ভালো হবে আশা করা যাচ্ছে।