২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১৬:২৩

নদীর চরে কাশফুলের মেলা

সাজ্জাদ হোসন, নড়াইল

নদীর চরে কাশফুলের মেলা

বাংলা বর্ষপঞ্জিকা অনুযায়ী সময়টা চলছে ঋতুর রানি শরৎকাল। এ মৌসুম এলেই নদ-নদী আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপার লীলাভূমি নড়াইলের চিত্রা, মধুমতী, নবগঙ্গা, কাজলা, নলিয়া, আঠারোবাঁকি ও ভৈরব নদীর বুকে জেগে ওঠে ছোট-বড় প্রায় ৫০-৬০টি চর। এসব চরে বসেছে সাদা মেঘের ভেলার মতো কাশফুলের মেলা। এসব নদ-নদীর তীরে মাঠজুড়ে শুধু সাদা কাশফুলের সমারোহ। এভাবে নদ-নদীর অববাহিকায় অর্ধ শতাধিক চরাঞ্চলে জেগে ওঠা বালুমাটিতে বিশাল পরিসরে কাশবন সৃষ্টি হয়েছে। শরৎ মানেই আকাশে নরম পেঁজা তুলোর মতো শুভ্র মেঘের ভেসে বেড়ানো আর দিগন্তজোড়া প্রান্তরে কাশফুলের মনোরম দৃশ্য।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জেলা শহর থেকে পূর্বে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরত্বে কালিয়া উপজেলার বাবরা-হাচলা ইউনিয়নের কাঞ্চনপুর খেয়াঘাট সংলগ্ন নবগঙ্গা নদীর পশ্চিম তীরের অববাহিকায় বিশাল একটি চরজুড়ে ছেয়ে গেছে কাশবন। সাদা রঙের কাশফুলে ভরে উঠেছে কাশবন। দূর থেকে দেখে মনে হবে বিশাল আকৃতির সাদা বিছানা চাদর বিছিয়ে রাখা হয়েছে। যা জেলার আর কোথাও এতো বড় কাশবন খুঁজে পাওয়া যাবে না। মাঠের পর মাঠ যতদূর চোখ যায় শুধু কাশবন আর কাশফুল। 

এছাড়া লোহাগড়া উপজেলার মধুমতী নদীর চর দৌলতপুর, চর সুচাইল ও চর পাচাইলসহ বিভিন্ন চরাঞ্চলে প্রকৃতির আপন সাজে সেজে কাশফুলে দোলা দিচ্ছে। এ চিত্র এখন জেলার অর্ধ শতাধিক চরাঞ্চলে। পাশাশি গ্রামের পথে-প্রান্তরে কিংবা সড়ক সংলগ্ন বিভিন্ন জলাশয় বালু দিয়ে ভরাটকৃত পরিত্যক্ত জমি ও পতিত জমিতে কাশবন দেখা যায়। এমন প্রকৃতি ও সৌন্দর্যে যে কারও হারিয়ে  যেতে মন চাইবে। বিনোদনপ্রেমী তরুণ-তরুণীরা ছুটছেন এসব কাশবনের দিকে। গ্রাম কিংবা শহরের ক্লান্তি দূর করে প্রশান্তির মায়াবি আবেশ ছড়িয়ে দিচ্ছে দিগন্তজোড়া কাশফুল। সেই কাশফুলের রাজ্যে গাঁ ভাসাতে অনেকেই ভিড় জমাচ্ছে। এ সময় মুঠোফোনে ধারণ করে রাখে তারা মনোরোম এসব দৃশ্য। ছবি আর সেলফি তুলে স্মৃতি হিসেবে ক্যামেরাবন্দি করছে নিজেদের।

স্থানীয়রা জানান, কাশবন শুধু সৌন্দর্যই বাড়ায়নি, এসব কাশগাছ বিক্রি করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন অনেকে। নিজ থেকে অথবা বাড়তি পরিচর্যা ও সার প্রয়োগ ছাড়াই বীজ ছিটিয়ে দিলেই কাশবনের সৃষ্টি হয়ে থাকে। এছাড়া প্রতিবছর বন্যা-পরবর্তী সময়ে নদ-নদীর অববাহিকায় বালুমাটি জমে। সেখানেই জন্ম নেয় কাশগাছ। কাশবনের ব্যবহার বহুবিধ। চারাগাছ একটু বড় হলেই এর কিছু অংশ কেটে গরু-মহিষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কাশ দিয়ে গ্রামের বধূরা ঝাটা, ডালি, দোন তৈরি করে। এছাড়া গ্রামাঞ্চলে ঘরের ছাউনি,বেড়া নির্মাণ করা হয়ে থাকে। আমাদের অর্থনৈতিক ফসল পানগাছের ছাউনি ও বরজেও ব্যবহার হয়ে থাকে কাশ। ফলে কোনো প্রকার ব্যয় ছাড়াই কাশবন বিক্রি করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন চরাঞ্চলের মানুষ। এক বিঘা জমির কাশের বাগান ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেন তারা। 

নবগঙ্গা নদী সংলগ্ন চান্দের চর গ্রামের বাসিন্দা ছানা মিয়া বলেন, ‘আমরা নদীভাঙা মানুষ। আমাদের এখানে কোনো প্রকার ব্যয় ছাড়া কাশবন হয়। বন্যার পর প্রতিবছর এমনিতেই চরের জমিতে জন্ম নেয়। লোকজন এসে এগুলো কিনে নিয়ে তারা পানের বরজে, ঘরের ছাউনি ও বেড়া দেয়ার কাজেও ব্যবহার করে থাকে।’ কাশ বিক্রির টাকা দিয়েই সন্তানের লেখাপড়া ও সংসারে খরচ চলে বলে জানান তিনি। 

কাশবনে ঘুরতে আসা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী নির্জনা হোসেন বলেন, ‘শহরের কোলাহল আর ঘরবন্দি থাকতে থাকতে মনমানসিকতা একঘেয়েমি হয়ে গেছে। তাই কাশবন দেখে বিকেলটা ভালোই কেটেছে। এখানে না এলে বোঝা যাবে না। এ এক অন্যরকম অনুভূতি। মন ভরে ওঠে, মুগ্ধ হয়ে যায়।’ এ সময় তার সঙ্গে থাকা ছোট্ট শিশু জোহানা হোসেনও কাশফুলে মুগ্ধ ও পুলকিত।

কালিয়া পৌর মেয়র ওয়াহিদুজ্জামান হীরা বলেন, ‘আমার পৌর শহর ঘেষে বয়ে চলা নবগঙ্গা নদীর অনেক স্থানে জেগে ওঠেছে বিশাল বিশাল চর। বালু চরে কোনো ফসলাদিও হয় না। এ চরে কেউ কাশবন চাষ করেননি। পরিচর্যাও করা লাগেনি। নিজ থেকেই চরজুড়ে কাশবন-কাশফুলে ছেয়ে গেছে। কাশফুল দেখতে প্রতিদিন দূর- দূরান্ত থেকে বিভিন্ন বয়সী মানুষ ছুটে আসছে।’

নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এ.কে.এম আহসান হাবীব জানান, ‘ঋতুপরিক্রমায় এখন শরৎকাল। আর সেই শরৎকালের বৈশিষ্ট্য কাশফুল। কাশফুলের আদিনিবাস শুধু রোমানিয়ায়। এটি বাংলাদেশেরও একটি পরিচিত উদ্ভিদ। কাশফুলের ইংরেজি নাম ক্যাটকিন। কাশফুলে রয়েছে বহুবিধ ব্যবহার। কাশ সাধারণত শুকিয়ে খড় হিসেবে গোখাদ্যের ব্যবহারও করা হয়। চারিদিকে এখন কাশফুলের সমারোহ। এ ছাড়া কাশফুলের বেশ কিছু ঔষধি গুণ রয়েছে। যেমন পিত্তথলিতে পাথর হলে নিয়মিত গাছের মূলসহ অন্যান্য উপাদান দিয়ে ওষুধ তৈরি করে পান করলে পিত্তথলির পাথর দূর হয়।’


বিডি প্রতিদিন/হিমেল

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর