বুধবার, ১০ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বললেন বঙ্গবন্ধুকে সম্মান করে ব্রিটেন সম্মানিত

আ স ম মাসুম, লন্ডন

৮ জানুয়ারি, ১৯৭২। লন্ডনে কনকনে ঠাণ্ডা। তাপমাত্রা ৪ থেকে ৬ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করছে। এমন হাড়কাঁপানো শীতে ব্রিটেনের জন্য তথা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের জন্য এক মুহূর্তের উষ্ণতা নিয়ে দেশটির হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করে পাকিস্তান এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট। এর ঠিক ঘণ্টাখানেক আগে ব্রিটেন জানতে পারে এই বিমানে করেই নামছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর এভাবেই এক মহানায়কের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে যায় ব্রিটেনের নাম। বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে চাইছিলেন তিনি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে সরাসরি বাংলাদেশেই ফিরবেন। পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমদ ইরান-তুরস্ক রুট ধরে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকায় ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। কিন্তু এ রুটটি পছন্দ হয় না বঙ্গবন্ধুর। তিনি কেবল ঢাকায় ফিরতে চান এবং তা সরাসরি। আজিজ আহমদ জানালেন, এটি সম্ভব নয়। কারণ ভারতের আকাশসীমা তারা ব্যবহার করতে পারবেন না। আজিজ আহমদ বলেন, ‘আমরা চাইছি পাকিস্তান এয়ারলাইনসে আপনাকে ফেরত পাঠাতে। যেহেতু আমরা ভারত হয়ে যেতে পারব না তাই অন্য একটি দেশে আপনাকে যেতে হবে।’ শেষ পর্যন্ত অন্য দেশ হিসেবে ব্রিটেনকে বেছে নেওয়া হয়। এরপর ৮ জানুয়ারি, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা বজায় রেখে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডন পৌঁছে দেয় পাকিস্তান। হিথরোয় বিমান অবতরণের মাত্র এক ঘণ্টা আগে ব্রিটেন জানতে পারে, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অল্প সময়ের মধ্যেই লন্ডন এসে পৌঁছছেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই বিমানে ছিলেন সহযাত্রী ড. কামাল হোসেন। দ্রুতগতিতে খবরটি ছড়িয়ে পড়ে। এদিন বিবিসির ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে ভোরের খবরে জানিয়ে দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুর লন্ডন আগমনের খবর। তারা জানায়, কিছুক্ষণের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী প্লেন হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করবে। তাকে বরণ করে নিতে ৮ জানুয়ারি ভোরে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে আলাদা প্রাণচাঞ্চল্য জাগে। এরই মধ্যে ব্রিটেন সিদ্ধান্ত নেয়, তারা বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদান করবে, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বরণ করবে। বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বরণ করে নেন ফরেন অফিসের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা স্যার ইয়ান সাদারল্যান্ড। তিনি জানান, বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে ব্রিটেনের ক্ল্যারিজেস হোটেলে নিয়ে যাওয়া হবে। সবচেয়ে দামি অতিথিশালা ক্ল্যারিজেস হোটেলের নাম শুনে বঙ্গবন্ধু কিছুটা নাখোশ হন। তিনি বলেন, ‘আমার দেশের মানুষ যেন স্বস্তিতে এসে দেখতে পারে এমন কোনো হোটেল হলে ভালো হয়।’ ফরেন অফিসের কর্মকর্তা বলেন, ‘স্যার! একজন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে, রাষ্ট্রীয় সম্মান হিসেবে আমরা আপনাকে ক্ল্যারিজেস হোটেলে নিচ্ছি।’ হোটেলে পৌঁছার কিছু সময়ের পর লেবার পার্টির তৎকালীন লিডার (পরে প্রধানমন্ত্রী) হ্যারল্ড উইলসন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। হ্যারল্ড উইলসন হচ্ছেন প্রথম কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে সম্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধুর দিকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে তার প্রথম উচ্চারিত বাক্য ছিল, ‘গুডমর্নিং মিস্টার প্রেসিডেন্ট’। দুপুরেই ক্ল্যারিজেস হোটেলে আয়োজন করা হয় এক সংবাদ সম্মেলনের। এটিই ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুর প্রথম প্রেস কনফারেন্স। এতে আবেগঘন ভাষায় প্রবল আত্মবিশ্বাসী স্বরে তিনি বললেন, ‘আমি কনডেম সেলে ফাঁসির অপেক্ষায় ছিলাম, বাঁচব কি মরব কিছুই জানতাম না, তবে জানতাম বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।’ হোটেলের ভিতরে বক্তব্য দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু, বাইরে তখন হাজারো বাঙালির ভিড়। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত অভিজাত মেফেয়ার এলাকা। দলে দলে আসছে মানুষ। কীভাবে তারা খবর পেল, কে দিল খবর? কেউ কাউকে খবর দেয়নি, খবর উড়ে যায় কানে কানে, বাতাসের বেগে, এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। প্রচণ্ড শীত, মেঘ-বৃষ্টি সব উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয় তাদের প্রিয় বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য। যিনি তাদের দিয়েছেন একটি পতাকা, একটি মানচিত্র। বাইরে ভিড়ের খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু হোটেলের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ান। সমবেত জনতার উদ্দেশে হাসিমুখে হাত নাড়েন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে স্লোগান ওঠে, ‘জয় বাংলা’। বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পেয়ে বহু প্রবাসী বাঙালির চোখে জল এসেছিল সেদিন। বিকাল ৫টার দিকে বঙ্গবন্ধু গেলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে। তাকে বরণ করে নিলেন কনজারভেটিভ পার্টির লিডার, প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ। দুই রাষ্ট্রনায়কের মধ্যে বৈঠক হলো আন্তরিক পরিবেশে। বৈঠকের একপর্যায়ে এডওয়ার্ড হিথ জিজ্ঞাস করলেন, ‘আপনাকে আর কী সহযোগিতা করতে পারি, বলুন।’ তত্ক্ষণাৎ বঙ্গবন্ধু উত্তর দিলেন, ‘আপনার প্লেনটা চাই, ওটা দিতে পারবেন, আমি খুব দ্রুত দেশে ফিরতে চাইছি।’ এডওয়ার্ড হিথ ব্যবস্থা নিলেন সঙ্গে সঙ্গে। বৈঠক চলার সময়ই নিশ্চিত হয়ে গেল ব্রিটিশ রাজকীয় কমেট জেট বিমানে করে ৯ জানুয়ারি সকাল ৭টায় বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেবেন জাতির জনক। বৈঠক শেষে ঘটে একটা অভাবনীয় ঘটনা। বিদায় নিয়ে যখন বঙ্গবন্ধু তার গাড়িতে উঠবেন তখন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ নিজে এগিয়ে এসে তাঁর জন্য গাড়ির দরজা খুলে দিলেন। দরজা ধরে তিনি ততক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ভিতরে গিয়ে না বসলেন। আর কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য, আর কোনো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এমন সম্মান দেখাননি কখনো, কস্মিনকালেও। ঘটনা নিয়ে তখন প্রধানমন্ত্রী হিথের সমালোচনা করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু এক বাক্যে সেই সমালোচনাকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন হিথ। বলেছিলেন, ‘আমি যাকে সম্মান করেছি, তিনি হচ্ছেন একটি জাতির মুক্তিদাতা মহান বীর। তাঁকে এই সম্মান প্রদর্শন করতে পেরে বরং আমরাই সম্মানিত হয়েছি।’ সকাল হলেই বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পথ ধরবেন। তাকে স্বাগত জানাবে বলে অপেক্ষার প্রহর গুনছে ৭ কোটি মানুষ।

বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে গাইলেন, আমার সোনার বাংলা : ৯ জানুয়ারি, ১৯৭২। ভোর ৬টা। লন্ডন হিথরো বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে পৌঁছালেন বঙ্গবন্ধু। তাঁকে স্বাগত জানালেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিভাগের কর্মকর্তা ইয়ান সাদারল্যান্ড ও লন্ডনে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার আপা বি পন্থ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ করিয়ে দেন আপা বি পন্থ। ৩০ মিনিট ধরে চলে ইন্দিরা-মুজিব টেলিফোন আলাপচারিতা। ঘণ্টাখানেক পরে ইন্দিরা গান্ধী আবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন।

ইন্দিরা গান্ধীর সম্মতিতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশে যাত্রাপথে সহযাত্রী হলেন ব্রিটেনস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের তৎকালীন রাজনৈতিক কর্মকর্তা শশাঙ্ক ব্যানার্জি। সঙ্গে ছিলেন সে সময়ের ভারতীয় হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি ভেদ মারওয়া। আরও ছিলেন স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী হামিদা হোসেন।

বিমানে তাঁরা পাশাপাশি আসনে বসলেন। সামনের টেবিলে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় সুগন্ধময় এরিনমোর তামাক, আর সেই বিখ্যাত পাইপ। উত্ফুল্ল মুজিবের তখন দেশে ফেরার তর সইছে না।

আপ্লুত কণ্ঠে তিনি বলে উঠলেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।’ তিনি ধন্যবাদ জানালেন দীর্ঘদিন তাঁকে সহযোগিতার জন্য। বললেন, ‘ব্যানার্জি! এবার একটি বিশেষ সহযোগিতা চাই।’ শশাঙ্ক বললেন, ‘আয়ত্তের মধ্যে হলে অবশ্যই চেষ্টা করব।’ ধীর লয়ে মুজিব বললেন, ‘দিল্লিতে ইন্দিরার সঙ্গে বৈঠকের আগেই তাঁর কাছে একটি খবর পৌঁছানো দরকার। বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনী সদস্যদের ৩১ মার্চ, ১৯৭২ সালের মধ্যে ভারতে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি চূড়ান্ত করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর এ বিষয়ে কথা হয়েছে। ভারতীয় মিত্রবাহিনী চলে গেলে বাংলাদেশ ব্রিটিশ সরকারের স্বীকৃতি পেতে আর কোনো বাধা থাকবে না।’

মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি নিয়ে বিমানটি আবার উড়তে শুরু করেছে। বঙ্গবন্ধু জানালা দিয়ে শ্বেতশুভ্র সাদা মেঘের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর দাঁড়িয়ে গাইতে লাগলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’। তাঁর চোখ ভরে উঠেছে জলে। তিনি বললেন, ‘ব্যানার্জি! আপনিও ধরুন। রিহার্সেল দিয়ে নিই।’ তাঁরা দুজনে মিলে গানটা গাইলেন। বঙ্গবন্ধু চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করে বললেন, ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আরও কঠোর সংগ্রাম অপেক্ষা করে আছে। বুকে শুধু একটাই বল, আমার দেশের আপামর মানুষ।’

শশাঙ্ককে অবাক করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘এ গানটি হবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। কেমন হবে বলেন তো?’ শশাঙ্ক জবাব দিলেন, ‘ইতিহাসে তাহলে প্রথমবারের মতো দুটি দেশের জাতীয় সংগীতের লেখক হবেন একই ব্যক্তি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’

শশাঙ্ক ব্যানার্জি বললেন, ‘দিল্লি অবতরণের তখন আর সময় বেশি বাকি নেই। পাইলট আমাদের দুটি ছবি তুলে দিলেন। শেখ মুজিবের সঙ্গে তোলা সেই ঐতিহাসিক ছবিটি এখনো খুব যত্ন করে তুলে রেখেছি।’

দিল্লিতে শেখ মুজিবকে স্বাগত জানালেন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংসহ আরও অনেকে। রাষ্ট্রপতি ভবনে বঙ্গবন্ধুর জন্য কলকাতা থেকে আনা গুড়ের সন্দেশ, সমুচা, শিঙ্গাড়া আর দার্জিলিং চা তাঁকে তৃপ্তি দিয়েছিল। মুজিব-ইন্দিরা বৈঠকে তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাদের ফিরিয়ে আনার বিষয়টি নিয়ে কথা হয়।

১০ জানুয়ারি, ১৯৭২। দুপুরে বিমান থেকে ঢাকায় নামলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জনস্রোত আর মানুষের স্লোগানে মুখরিত চারপাশ। সোচ্চার ধ্বনি উঠছে, ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘জয় মুক্তিযুদ্ধ’। বিমানবন্দর থেকে পল্টন ময়দান এক বিপুল জনসমুদ্র। শশাঙ্ক বলেন, ‘সে এক অভূতপূর্ব মুহূর্ত, চারদিকে মুক্তি আর মহানেতাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ। আজও চোখে লেগে আছে মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনটি।’

তথ্যসূত্র : ‘বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তেরো ঘণ্টা’, লেখক : উজ্জ্বল দাশ, ‘বিলেতে বাংলার রাজনীতি’, লেখক : ফারুক আহমদ ও ‘বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’, লেখক : সাঈম চৌধুরী।

সর্বশেষ খবর