শনিবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

পদত্যাগ করলেন ওয়াহ্‌হাব মিঞা

দেখালেন ব্যক্তিগত কারণ । বঙ্গভবনে আজ নতুন প্রধান বিচারপতির শপথ

আরাফাত মুন্না

পদত্যাগ করলেন ওয়াহ্‌হাব মিঞা

দেশের ২২তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে আপিল বিভাগের দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারির পরপরই পদত্যাগ করেছেন গত ২ অক্টোবর থেকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করে আসা আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা। দৃশ্যত প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ না পেয়ে চাকরির মেয়াদের ১০ মাস আগেই পদত্যাগ করলেন ওয়াহ্হাব মিঞা। তবে গতকাল রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো চিঠিতে তা প্রকাশ করেননি তিনি। পদত্যাগের কারণ দেখিয়েছেন ব্যক্তিগত। 

তার আগে গতকাল দুপুরে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন সাংবাদিকদের বলেন, ‘নতুন প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নিয়োগের আদেশে রাষ্ট্রপতি সই করেছেন। শনিবার সন্ধ্যা ৭টায় নতুন প্রধান বিচারপতিকে শপথ পড়াবেন রাষ্ট্রপতি।’ এরপর বিকালে আইন মন্ত্রণালয় নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করে। ১৯৯৯ সালের ২৪ অক্টোবর হাই কোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা। তার দুই বছর পর ২০০১ সালের শুরুতে হাই কোর্ট বিভাগে বিচারপতির দায়িত্ব শুরু করেন সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। এদিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম।

এদিকে গতকাল সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটে বঙ্গভবনের ফটকের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। গ্রহণ সিলসহ ওই পদত্যাগপত্রের একটি অনুলিপি বাংলাদেশ প্রতিদিনের হাতেও আসে। রাষ্ট্রপতি বরাবরে দেওয়া ওই পদত্যাগপত্রে তিনি লিখেছেন, ‘আমি নিম্ন স্বাক্ষরকারী, আমার অনিবার্য ব্যক্তিগত কারণবশত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারকের পদ হইতে এতদ্বারা পদত্যাগ করিলাম। অনুগ্রহপূর্বক এই পদত্যাগপত্রখানা গ্রহণ করিয়া আমাকে বাধিত করিবেন।’ বিকালে আপিল বিভাগের এই জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টের কার্যালয় থেকে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে গেছেন বলেও সূত্র নিশ্চিত করেছে। পরে রাতে বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন সদ্য নিয়োগ পাওয়া প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন।

বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার পদত্যাগপত্র পেয়েছেন কিনা— এ বিষয়ে জানতে চাইলে তা স্পষ্ট না করে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শুক্রবার ছুটির দিন, তাই রাষ্ট্রপতির কাছে এমন কিছু পৌঁছার সম্ভাবনা নেই।’

বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকেই দেশের ২২তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতে পারে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে বলা হচ্ছিল। শেষের দিকে তার নিয়োগ অনেকটাই চূড়ান্ত বলে জানিয়েছিল সূত্রগুলো। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম উপস্থিত ছিলেন। এ বৈঠকের পরই রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে নিশ্চিত হওয়া যায়। বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ না দেওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে কিছু মতামত পাওয়া গেছে। তারা মনে করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলে আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের মতে রায় এসেছিল, ওই রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে মত জানিয়েছিলেন বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞা। যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ের সময় একমাত্র বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিঞার দ্বিমত ছিল। এ ছাড়া যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিরা দণ্ড দিলেও তিনি দিয়েছিলেন খালাস। সুপ্রিম কোর্টের তথ্যানুসারে, জামালপুরের প্রয়াত আবদুস সাত্তার মিঞা ও প্রয়াত সৈয়দা তাহেরা বেগমের ঘরে ১৯৫১ সালের ১১ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন আপিল বিভাগের এই জ্যেষ্ঠ বিচারপতি। ১৯৯৯ সালের ২৪ অক্টোবর তিনি হাই কোর্ট বিভাগের বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। পরে ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তাকে আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

পদত্যাগের নজির : জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. রুহুল আমিন ও বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমকে ডিঙিয়ে যথাক্রমে বিচারপতি কে এম হাসান ও বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছের হোসেনকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও বিচারপতি এম এম রুহুল আমিনকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয় জ্যেষ্ঠ বিচারক বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমকে ডিঙিয়ে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমকে ডিঙিয়ে বিচারপতি তাফাজ্জাল ইসলামকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। যদিও পরে বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে নিয়োগ দেওয়া হয় বিচারপতি এম এ মতিন ও বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে ডিঙিয়ে। এ ছাড়া সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনকে নিয়োগের সময়ও ফের বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানকে ডিঙানো হয়। যার ফলে দীর্ঘ ছুটিতে গিয়ে পরে বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পদত্যাগ করেন। এরপর জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের ঘটনায় সবশেষ গতকাল বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা পদত্যাগ করলেন।

নতুন প্রধান বিচারপতির শপথ আজ : আপিল বিভাগের দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে দেশের ২২তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। গতকাল তার এই নিয়োগ চূড়ান্ত করার পর আজ তাকে শপথের জন্য ডাকা হয়েছে। সন্ধ্যা ৭টায় বঙ্গভবনে নতুন প্রধান বিচারপতিকে শপথ পড়াবেন রাষ্ট্রপতি।

আড়াই মাস আগে বিচারপতি এস কে সিনহার পদত্যাগের পর আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি হিসেবে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা। নতুন প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণের পর সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে হবে তাঁকে। নতুন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন অবসরে যাবেন ২০২১ সালের ৩০ নভেম্বর।

নানা নাটকীয়তার মধ্যে বিচারপতি এস কে সিনহা গত নভেম্বরে পদত্যাগ করার পর থেকে প্রধান বিচারপতির পদটি শূন্য ছিল। রাষ্ট্রপতি তখন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারক মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে দায়িত্ব পালন করে যেতে বলেন। সময় গড়ালেও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ না হওয়ায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রতিনিয়ত প্রশ্নের মুখে পড়ছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সব সময়ই প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার বলে জানিয়েছেন তিনি। এমনকি গতকাল দুপুরেও বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় রাষ্ট্রপতি আজকেই কিছুক্ষণের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির নাম ঘোষণা করবেন।’ এর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বঙ্গভবন থেকে তা নিশ্চিত করা হয়। রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন সাংবাদিকদের বলেন, ‘নতুন প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নিয়োগের আদেশে রাষ্ট্রপতি সই করেছেন। শনিবার সন্ধ্যা ৭টায় নতুন প্রধান বিচারপতিকে শপথ পড়াবেন রাষ্ট্রপতি।’

এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে আইন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা ড. মো. রেজাউল করিম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘সংবিধানের ৯৫(২) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করেছেন। এই নিয়োগ তার শপথ গ্রহণের তারিখ থেকে কার্যকর হবে।’ সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করিবেন।’ আওয়ামী লীগ সরকার আমলে নিয়োগ পাওয়া সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বিএনপি সরকার আমলে ২০০৩ সালে হাই কোর্টের স্থায়ী বিচারক হন। ২০১১ সালে তিনি আপিল বিভাগের বিচারক পদে উন্নীত হন। বিচারক হিসেবে কাজ শুরুর আগে তিনি আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে কাজ করেছিলেন।

বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের জন্ম ১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর। বিএসসি ডিগ্রি নেওয়ার পর এলএলবি ডিগ্রি নিয়ে ১৯৮১ সালে আইন পেশায় যুক্ত হন তিনি। তার দুই বছর পর আইন পেশা শুরু করেন হাই কোর্টে। নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতি গঠিত দুটি সার্চ কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। আপিল বিভাগে এখন যে পাঁচজন বিচারপতি রয়েছেন, তার মধ্যে আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা জ্যেষ্ঠতম। তার পরেই বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। জ্যেষ্ঠতার ক্রমে এর পরে রয়েছেন বিচারপতি মো. ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।

অ্যাটর্নি জেনারেলের স্বস্তি : নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগে স্বস্তিবোধ করছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম। গতকাল বিকালে সাংবাদিকদের দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘আমি খুব খুশি। স্বস্তিবোধ করছি। অপেক্ষার অবসান হলো।’ তিনি বলেন, এখন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে। তিনি আরও বলেন, শনিবার নতুন প্রধান বিচারপতির শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নেব। এ ছাড়া রবিবার অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতির কোর্টে নতুন প্রধান বিচারপতিকে অভিনন্দন জানাব। প্রধান বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করা হলেও কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতি ঘটবে না বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।

সর্বশেষ খবর