ইত্তেফাক ভবন থেকে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বেরুবে। নাম ‘রোববার’। নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছেন কবি রফিক আজাদ। সম্পাদকের নাম আবদুল হাফিজ। প্রকাশক ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন সাহেবের স্ত্রী সাজু হোসেন। আবদুল হাফিজ সাহেব অফিসে আসতেনই না। পত্রিকার সার্বিক দায়িত্ব রফিক আজাদের ওপর। নেপথ্যে আছেন রাহাত খান। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮ ঘণ্টাই আমি তখন রফিক আজাদের সঙ্গে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকোনমিক্স অনার্স পড়ছি। রোববারে জয়েন করলাম জুনিয়র রিপোর্টার হিসেবে।
বেতন ৪০০ টাকা। বেতন নিয়ে ভাবছিলাম না। রফিক আজাদের সঙ্গে থাকা যাবে, বড় বড় লেখক-কবির সঙ্গে পরিচয় হবে আর নিজের লেখালেখির একটা জায়গা তৈরি হবে- প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে এই। রোববারে কাজ করতে করতেই পরিচয় হলো ঔপন্যাসিক রিজিয়া রহমানের সঙ্গে। তখন তিনি খ্যাতির শীর্ষে। একের পর এক দুর্দান্ত সব উপন্যাস লিখছেন। রক্তের অক্ষরে, বং থেকে বাংলা, সূর্য সবুজ রক্তÑ এ রকম পাঠকনন্দিত সব উপন্যাস। শিল্পসম্মত সব উপন্যাস। ‘বিচিত্রা’র ঈদসংখ্যায় তার উপন্যাসগুলো পাঠক ব্যাপকভাবে লুফে নিতেন। লেখালেখির শুরু থেকেই রিজিয়া রহমান খুবই সিরিয়াস ধরনের। পাঠকের মুখ চেয়ে কিংবা তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তার লোভে তিনি কখনো কলম ধরেননি। আমি ছিলাম তাঁর লেখার একনিষ্ঠ ভক্ত। রিজিয়া রহমানের বাসায় আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ইকবাল হাসান। ইকবাল কবি। বরিশালের ছেলে। সাংবাদিকতা করে ইত্তেফাকের সহযোগী সিনেমা পত্রিকা ‘পূর্বাণী’তে। ইত্তেফাক ভবনেই অফিস। পূর্বাণীর সম্পাদক তখন গোলাম সারওয়ার। আমাদের প্রিয় সারওয়ার ভাই।
রিজিয়া আপা তখন থাকেন মগবাজারে। ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাড়ি যে গলিতে সে গলিতেই ছিল রিজিয়া আপার বাসা। এক দুপুরে ইকবাল আমাকে নিয়ে গিয়েছিল সেই বাসায়। পূর্বাণী পত্রিকার জন্য লেখা চাইতে গিয়েছিল ইকবাল। সেই প্রথম রিজিয়া আপাকে সামনাসামনি দেখলাম। অত্যন্ত সহজ-সরল স্নেহময়ী একজন মানুষ। নরম মিষ্টি গলায় কথা বলেন। প্রতিটি কথায় ঝরে পড়ে মমত্ববোধ। পান খেতে পছন্দ করেন। আমরা গিয়েছিলাম দুপুরবেলায়। তখনো খাওয়া হয়নি। রিজিয়া আপার বাসায় দুপুরের খাওয়া হয়ে গেছে। তার পরও তিনি নিজ হাতে আবার রান্না করলেন। গভীর মমতায় আমাদের দুজনকে খাওয়ালেন। ইকবাল তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তিনি বললেন, আমার দু-একটি লেখা তিনি পড়েছেন। শুধু ওইটুকুই।তারপর মাঝে মাঝেই রিজিয়া আপার কাছে যেতাম। লেখালেখি নিয়ে এক ধরনের উন্মাদ জীবনযাপন করছি। পকেটে পয়সা নেই। সকলবেলা বেরিয়ে রাত করে বাড়ি ফিরছি। দুপুরে অনেকদিন খাওয়াও হয় না। রিকশা ভাড়ার পয়সা, চা-সিগারেটের পয়সাও পকেটে থাকে না। হেঁটে হেঁটে যাই। কোনো কোনো দুপুরে চলে গেছি রিজিয়া আপার বাসায়। আমার মুখ দেখেই তিনি বুঝতে পারতেন খাওয়া হয়নি। ঘরে যা আছে তাই খেতে দিতেন বা আমাকে বসিয়ে ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে কিছু একটা রান্না করে নিয়ে আসতেন। সামনে বসিয়ে খাওয়াতেন। কত দিন আপার কাছ থেকে ৫০ টাকা, ১০০ টাকা চেয়ে নিয়ে আসতাম। তিনি কখনো না করতেন না। গভীর মমতায় হাসিমুখে দিতেন। যেন নিজের আদরের ছোট ভাইটিকে দিচ্ছেন। এমন একটা সম্পর্ক রিজিয়া আপার সঙ্গে আমার হলো, তিনি যে আমার আপন বড়বোন ননÑ এটা মনেই হতো না।
রোববার পত্রিকা দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে। অনেক লেখকই আসেন বিকালবেলা এখানে আড্ডা দিতে। চা-সিগারেট আর তুমুল আড্ডার মধ্য দিয়ে পত্রিকার কাজ হয়। অসাধারণ এক পরিবেশ।
একদিন দুপুরের পর রিজিয়া আপা এলেন রোববার অফিসে। শরীরে জ্বর ছিল তাঁর। তবু এসেছেন গল্প পৌঁছে দিতে। বললে আমি গিয়েই তাঁর বাড়ি থেকে লেখা নিয়ে আসতাম। ইচ্ছা করেই তিনি আমাকে বলেননি। রোববার অফিসটা দেখতে চেয়েছিলেন। বোধহয় এ কারণেই এসেছেন। আপাকে দেখে আমি মহা উচ্ছ্বসিত। রফিক আজাদের ছাত্র আরেফিন বাদল একটি সরকারি পত্রিকার সম্পাদক। সচিবালয়ে তাঁর অফিস। পত্রিকার নাম ‘প্রতিরোধ’। সেই পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যায় ছাপা হয়েছে আমার তৃতীয় উপন্যাস। উপন্যাসের নাম ‘দুঃখ কষ্ট’। রফিক আজাদকে নিয়ে লেখা উপন্যাস। উপন্যাসের প্রতিটি চ্যাপ্টার শুরু হয়েছে রফিক আজাদের একেকটি কবিতার লাইন দিয়ে। আমার খুব ইচ্ছা উপন্যাসটি রিজিয়া আপাকে পড়াই। কিন্তু হাতের কাছে পত্রিকাটি নেই। ইত্তেফাকের মোড় কিংবা মতিঝিলের ফুটপাথে বসা পত্রিকা হকারদের কাছে পাওয়া যাবে। রিজিয়া আপা বললেন, চল, পত্রিকাটা জোগাড় করি।
আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। না ইত্তেফাকের মোড়, না মতিঝিলের কোনো হকারের কাছে, কোথাও প্রতিরোধ পত্রিকাটি আর পাই না। আমি তো মহা উৎসাহে হাঁটছি। যেমন করেই হোক রিজিয়া আপাকে পড়াতে হবে উপন্যাস। এক স্টলে না পেয়ে হাঁটতে হাঁটতে আপাকে বলছি ওই তো আরেক স্টল দেখা যাচ্ছে আপা। ওখানে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
কোথাও পাই না। আপার শরীরে জ্বর। তাঁর হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে। আমি খেয়ালই করি না। আমার তো শরীর-ভরা উদ্যম। প্রতিরোধ পত্রিকা আপার হাতে দিতেই হবে। ওই রোদ গরম আর জ্বরে পুড়ে যাওয়া শরীর নিয়ে আপা আমার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে এলেন স্টেডিয়াম পর্যন্ত। স্টেডিয়ামের ফুটপাথে পত্রিকাটি পাওয়া গেল। তিনি তাঁর পয়সায় পত্রিকাটি কিনলেন। রিকশায় উঠতে উঠতে হাসিমুখে বললেন, শেষ কবে এত হাঁটা হেঁটেছি মনে পড়ে না।
সেদিন সন্ধ্যায়ই রোববার অফিসে ফোন করলেন রিজিয়া আপা। আমাকে চাইলেন। ফোন ধরার পর বললেন, আমার জ্বর ছিল। তুমি অতদূর হাঁটিয়েছ, বাড়ি এসে দেখি জ্বর আরও বেড়েছে। সেই অবস্থায় তোমার লেখাটা পড়তে শুরু করলাম। আশ্চর্য ব্যাপার, লেখাটা পড়ে আমার জ্বর ছেড়ে গেছে। খুব ভালো লিখেছ।
সেদিনের আগে এত বড় কোনো ঔপন্যাসিকের কাছ থেকে এমন প্রশংসা আমি আর পাইনি। তারপর কত কত দিন কেটে গেল জীবন থেকে। কত কতবার দেখা হয়েছে রিজিয়া আপার সঙ্গে। কত কথা হয়েছে সাহিত্য নিয়ে। যখনই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে বা কথা হয়েছে প্রতিবারই আমার মনে হয়েছে রিজিয়া আপা যেন সেই আটাত্তর সালের মতোই আছেন। সেই স্নেহময়ী বোনটি। সেই মমতাময়ী মানুষটি। সময় তাঁকে একটুও বদলাতে পারেনি।
গত কয়েকটি বছর ধরে শরীর ভালো নেই রিজিয়া আপার। চোখের জ্যোতি হারিয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। চোখে প্রায় দেখতেই পাচ্ছিলেন না। চলাফেরা করতেন হুইল চেয়ারে। একুশে পদক আনতে গিয়েছিলেন হুইল চেয়ারে বসেই। শরীরে বাসা বেঁধেছে ক্যান্সার। জীবন ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে তাঁর হাতের বাইরে। পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করি, আমার এই প্রিয় বড়বোনটির জীবন তিনি যেন আরও কিছুটা লম্বা করে দেন। এই সুন্দর পৃথিবীতে রিজিয়া রহমানের মতো ঔপন্যাসিক যেন আরও কতগুলো বছর কাটিয়ে যান।