মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

মাটি ডাকাতরা শেষ করে দিচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম

জিম্মি ৫০ হাজার মানুষ, গাছপালা ফসলি জমি ভিটেবাড়ি লুটে খাল-নদী

সাঈদুর রহমান রিমন, কেরানীগঞ্জ থেকে ফিরে

মাটি ডাকাতরা শেষ করে দিচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম

মাটি কেটে নিয়ে যাওয়ার পর বিস্তীর্ণ এলাকার এ অবস্থা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

সংঘবদ্ধ মাটি লুটেরা চক্রের ফাঁদে জিম্মি হয়ে পড়েছে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের ৫০ হাজারের বেশি বাসিন্দা। তাদের ফসলি জমি, গাছপালা, ভিটেবাড়ি কেটে, ছেঁটে, ধসিয়ে দিয়ে হাজার হাজার ট্রাক মাটি লুটে নেওয়া হচ্ছে। এসব মাটি নেওয়া হচ্ছে আশপাশের ৪০টি ইটভাটায়, সরবরাহ যাচ্ছে মাটি ভরাটের ঠিকাদারি কর্মকান্ডে। থানা পুলিশের পাহারায় চিহ্নিত সুজন-ডন-পলাশ বাহিনীর সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে অস্ত্রশস্ত্রের মহড়া দিয়ে ফাঁকা গুলিবর্ষণের আতঙ্ক ছড়িয়ে যেখানে সেখানে হামলে পড়ছে। স্ক্যাভেটর, ভেকুসহ মাটি খননের বৃহৎ যন্ত্রপাতি দিয়ে শত শত শ্রমিক রাতদিন মাটি খনন করে ট্রাকের পর ট্রাক ভরাট করে নিয়ে যাচ্ছে। কয়েক হাজার একর আয়তনের সমতল জায়গা, ফসলি জমি কিংবা ভিটেবাড়ি দফায় দফায় খনন করে রীতিমতো ২০-২২ ফুট গভীর খাদে পরিণত করেছে। এরই মধ্যে ব্রাহ্মণগাঁও, কাজীর গাঁ, দক্ষিণ বাগুরের অনেক বাড়িঘর এসব খাদে ধসে পড়েছে। কেউ কেউ বালির বস্তার বাঁধ বানিয়ে বাড়ির ঘরগুলো কোনোরকমে টিকিয়ে রাখলেও তাদের বসবাস চলছে সীমাহীন ঝুঁকিতে। ঘরের দরজার সামনে পা ফেলতে সামান্য অসতর্কতাতেই গভীর খাদে পড়ে হতাহতের আশঙ্কা গ্রামবাসীকে তাড়িয়ে বেড়ায় সর্বদা।

মাটি লুটেরা চক্র তাদের আগ্রাসী থাবায় বুড়িগঙ্গাসংলগ্ন কোন্ডা ইউনিয়নের ছয়টি গ্রামসহ প্রায় ৭ বর্গকিলোমিটার এলাকার চিরচেনা চেহারা আমূল বদলে দিয়েছে, পাল্টে দিয়েছে প্রকৃতি। যত দূর চোখ যায় খাঁখাঁ বিরানভূমি আর গভীর খানাখন্দে ক্ষতবিক্ষত বেহালচিত্রই দৃশ্যমান হয়। কোথাও একচিলতে ছায়া দেওয়ার মতো গাছপালার নজির পর্যন্ত রাখা হয়নি। ভারী খনন যন্ত্রপাতির অনর্গল শব্দ আর মাটিবাহী ট্রাকগুলোর অবিরাম ছুটে চলা গোটা এলাকার পরিবেশকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। সরকারের কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও মাটি লুটেরা চক্র সেখানে শত শত একর জায়গাজমির শ্রেণি পরিবর্তন ঘটিয়ে চলছে অহরহ। সেসব ব্যাপারে উপজেলা ও জেলা প্রশাসন রহস্যজনকভাবে নীরব ভূমিকা পালন করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগী বাসিন্দারা অভিযাগ করে বলেছেন, ‘আমাদের জায়গাজমিতে জোরপূর্বক গভীর খাদ বানিয়ে মাটি লুটে নেওয়া হলেও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ বরাবরই লুটেরা চক্রের পক্ষ নিয়ে থাকে। কোনো এলাকায় সুজন-ডন-পলাশ চক্রের মাটি খননের কাজ শুরুর আগেই সেখানে থানা পুলিশের অন্তত দুটি টহল গাড়ি সর্বক্ষণ অবস্থান করে। প্রকাশ্যে জায়গা খনন করা হলেও বাধা দেওয়ার উপায় নেই। কেউ প্রতিবাদ করতে গেলে ভেকু মেশিনের চালকও অস্ত্র তাক করে, ফাঁকা গুলি ছোড়ে। তৎক্ষণাৎ পুলিশ এসে জমির মালিকদেরই উল্টো ধাওয়া দেয়, মারধর করে। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় সরেজমিন গিয়ে কান্দাপাড়ার অদূরে বড় বড় চারটি যন্ত্রপাতি লাগিয়ে ব্যাপকভাবে মাটি খনন চালাতে দেখা যায়। শ্রমিকরা জানান, স্থানীয় ইউনিয়ন শ্রমিক লীগ সাধারণ সম্পাদক সুজন মিয়ার নেতৃত্বে তারা মাটি খনন করে তারই মালিকানাধীন সুজন ব্রিকসে (ইটভাটা) সরবরাহ করছেন। খবর পেয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই সুজন ও তার ২০-২২ সহযোগী ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে রীতিমতো মারমুখী আচরণ শুরু করেন। গ্রামের যেসব বাসিন্দা সাংবাদিকদের কাছে বক্তব্য দিচ্ছিলেন তাদেরকে হুমকি-ধমকি দিতে থাকেন সুজন।

অপরাধ অপকর্মের শিরোমণি : নাম সুজন হলেও অপকর্মের অভিযোগের শেষ নেই এই তার বিরুদ্ধে। সুজন মিয়ার সব অপকর্ম হচ্ছে খোদ পুলিশের সামনেই। এলাকাবাসীর অভিযোগ, সুজনের বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ করা হলেও উল্টো পুলিশই গ্রামবাসীদের নামে মামলার হুমকি দেয়। যদিও প্রশাসন বলছে, বিষয়টি নিয়ে তারা তৎপর। প্রশাসনের মতে, অন্যায়কারী যে-ই হোক, তাকে বিচারের আওতায় আনা হবে। জানা গেছে, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের কোন্ডা ইউনিয়নের ব্রাহ্মণগাঁও, কাজীর গাঁও, দক্ষিণ পানগাঁও, পানগাঁও ও কাউটাইলে সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী গড়ে তুলেছেন সুজন মিয়া, ডন, পলাশ। তাদের বাহিনী এলাকায় চাঁদাবাজির পাশাপাশি দখলদারির রাজত্ব কায়েম করেছে। ফসলি জমিসহ, রাস্তাঘাট, অন্যান্য জমি জবরদখল করে মাটি উত্তোলন করে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে তা বিক্রি করছেন। এতে জমিতে তৈরি হচ্ছে গভীর খাদ, উৎপাদন করা যাচ্ছে না কোনো ফসল। বৃষ্টি এলে তলিয়ে যায় গোটা এলাকা। এতে একদিকে যেমন ফসলি জমি শেষ হয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে পরিবেশও রয়েছে মারাত্মক হুমকিতে। অনেক বাড়িঘর ইতিমধ্যে মাটি উত্তোলনের ফলে বিলীন হয়ে গেছে। ভেঙে পড়েছে রাস্তা। উজাড় হয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি। এ ছাড়া তার গঠিত বাহিনী এলাকাবাসীর কাছ থেকে শুরু করেছে চাঁদাবাজি। নির্দিষ্ট চাঁদা না পেলে দেওয়া হয় হত্যার হুমকি। তার চাঁদাবাজি ও দখলের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই এলাকাছাড়া করার হুমকি দেওয়া হয়। আর এসব কর্মকান্ড খোদ পুলিশের সামনে করলেও পুলিশ অজানা কারণে নীরব থাকে। এ যেন মগের মুল্লুক!

কুয়েতপ্রবাসী ইসলাম ২০ লাখ টাকা দিয়ে ৬ শতাংশ জমি কিনেছিলেন। তার কেনা জমিতে চলতি বছরের শুরুর দিকে বাড়ি তৈরির ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তার জমির কোনো চিহ্ন এখন নেই। তার জমিসহ ব্রাহ্মণগাঁও এলাকাটি এখন গভীর খাদ। একই অবস্থা গ্রামটির হালিম দোকানদার, দেলোয়ার, আইয়ুব আলী, আফসারসহ পাঁচ-ছয়টি গ্রামের ৫০ হাজার বাসিন্দার। এ বিষয়ে হালিম বলেন, ‘গভীর রাতে এমনকি দিনের বেলায়ও সুজন, ডন ও পলাশের লোকজন আমার বাড়ির জমিটি শেষ করে দিয়েছে। এখন আর বাড়ি করার উপায় নেই। পুলিশকে জানালে উল্টো পুলিশ মামলার হুমকি দেয়।’ খুকি বলেন, ‘আমার জমির ওপর ছোট ঘর তৈরি করেছিলাম। ইচ্ছা ছিল ইটের বাড়ি বানানোর। কিন্তু আমার জমিতে জোর করে মাটি ও বালু উত্তোলন করায় জমির কোনো চিহ্ন নেই। এখন অন্যের বাড়িতে থাকতে হচ্ছে।’ তবে স্থানীয় প্রশাসন বলছে, অন্যায়কারী যে-ই হোক, তাকে বিচারের আওতায় আনা হবে। এ বিষয়ে কেরানীগঞ্জে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) অমিত দেবনাথ বলেন, ‘আমরা ফসলি জমি বা বিভিন্ন জমিতে মাটি উত্তোলনের বিষয়টি নিয়ে তৎপর আছি। আমরা যেহেতু বিষয়টি জানতে পেরেছি, অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’ তিনি বলেন, ‘ভেপু (মাটি উত্তোলনের যন্ত্র) ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার নিষিদ্ধ, তবে সরকারি কোনো স্থাপনা বা রাস্তাঘাট নির্মাণে ব্যবহার করা যায়। এখন জানতে পারলাম সেখানে একটি গোষ্ঠী এটা ব্যবহার করে মাটি উত্তোলন করছে। আমি অবশ্যই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেব।’

কে এই সুজন মিয়া : আজ থেকে ১০-১২ বছর আগে সুজন মিয়া বুড়িগঙ্গা নদীতে মাঝির কাজ করে সংসার চালাতেন। পরে মাঝি থেকে হয়ে যান নৌডাকাত, গড়ে তোলেন সন্ত্রাসী সংগঠন। নিজ কব্জায় নিয়ে নেন ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার সম্পদ দখলে নেন। শুরু করেন ফসলি জমির মাটি ও বালু উত্তোলন। এগুলো বিক্রি করতে থাকেন ইটভাটাসহ বিভিন্ন জায়গায়। জবরদখল করে অন্যের জমির মাটি উত্তোলন করে গভীর খাদে পরিণত করেন। এতে বসতবাড়ি ও সরকারি রাস্তা হুমকির মুখে পড়ে। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহজামাল বলেন, ‘মাটি উত্তোলন আমরা বন্ধ করেছি। এখন কোন্ডা ইউনিয়ন থেকে কোনো ধরনের মাটি উত্তোলন হচ্ছে না। মাটি উত্তোলন এখন বন্ধ আছে।’ তবে গতকাল সরেজমিন গিয়ে এই প্রতিবেদক ২০টির বেশি ট্রাকে মাটি পরিবহন ও উত্তোলনের চিত্র দেখেছেন যার তথ্য-প্রমাণ সংরক্ষিত আছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।’

সর্বশেষ খবর