বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

সেই মাফিয়া চক্র কারা

সাঈদুর রহমান রিমন

বন্ড সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা আবুল হোসেনসহ শীর্ষ পর্যায়ের ৬৭ চোরাচালানকারী দেশের ‘বন্ড মাফিয়া’ হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে। তাদের জাল-জালিয়াতি, হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি, হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার, দেশীয় শিল্প-কারখানা বন্ধসহ রাষ্ট্রের ধ্বংসাত্মক নানা অপকর্মের বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে গোয়েন্দাদের হাতে। তবু অজ্ঞাত ক্ষমতার বিশাল দাপটে তারা থাকছেন বহাল তবিয়তে। এই মাফিয়ারা একেকজন এতটাই প্রভাবশালী যে নানা উদ্যোগ-আয়োজন নিয়েও তাদের অপকর্ম থামাতে পারছে না কেউ। বন্ড সুবিধার পণ্য খোলাবাজারে বিক্রির মাধ্যমে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ওঠা এই মাফিয়াদের একেকজনের সাত থেকে ১০টি পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আর এই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই বন্ড সুবিধার আওতায় কোটি কোটি টাকার পণ্য আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। বন্ড মাফিয়া প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই আছে জাল-জালিয়াতি ও বন্ড লুটপাটের মামলা। দফায় দফায় অভিযানে তাদের গুদাম ও গাড়িবহর থেকে জব্দ করা হয়েছে শত শত কোটি টাকার মালামাল। কিন্তু তাদের চূড়ান্ত শাস্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বরাবরই সরকারের দায়িত্বশীলরা রহস্যময় ধীরে চলো নীতি পালন করে চলছেন। বরং ২০১৫ সালে ঢাকা বন্ড কমিশনারেট থেকে এ-জাতীয় ৪৭৭টি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে লাইসেন্স সাময়িকভাবে বাতিল ও ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। কিন্তু তারাও এখন একেকজন মাফিয়া সিন্ডিকেটে সম্পৃক্ত হয়ে লুটপাটের অপকর্মে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। দেশের সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতি হিসেবে চিহ্নিত বন্ড লুটপাটের অপকর্ম পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখতে শীর্ষ মাফিয়া আবুল হোসেন ও তার সহচররা নানা পথ বেছে নিয়েছেন। নিজেদের রক্ষায় সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত একটি মহলকে অঘোষিত লবিস্ট নিয়োগ করার পাশাপাশি ব্যবসায়িক জনপ্রতিনিধিদের রেখেছেন তাদের রক্ষাকবচ হিসেবে। অন্যদিকে বন্ড অপকর্ম ও দেশের বাজারব্যবস্থা নিজেদের কব্জায় রাখতে ‘আবুল চক্র’ বড় আকারের সন্ত্রাসী বাহিনী পুষে থাকে। মাসিক বেতনের ভিত্তিতে শতাধিক অস্ত্রবাজের গ্রুপটি পুরান ঢাকার কাগজ মার্কেট ও কাগজ ব্যবসায়ী সমিতির কার্যালয় এলাকায় সার্বক্ষণিক অবস্থান করে। আবুল হোসেনের নয়তলার বিশাল ভবনটির একটি ফ্লোর শুধু সন্ত্রাসীদের বিনোদন ক্লাব ও থাকা, খাওয়া, ঘুমানোর কাজে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তারা শিফট অনুযায়ী পালাক্রমে বন্ড বাণিজ্যের দোকানপাট ও গুদামগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকে। নির্দেশনা অনুযায়ী এ অস্ত্রবাজ চক্র এর আগে বন্ডবিরোধী অভিযান পরিচালনাকারী শুল্ক গোয়েন্দা ও পুলিশের ওপর কয়েক দফা হামলা পর্যন্ত চালায়। গতকালও নয়াবাজার এলাকায় বন্ড মাফিয়াদের বেতনভুক্ত দুর্বৃত্তরা নিউজ টোয়েন্টিফোর চ্যানেলের রিপোর্টার ও ক্যামেরাপারসনের ওপর ন্যক্কারজনক হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। জানা গেছে, রাজধানীর ইসলামপুর ও নয়াবাজারকেন্দ্রিক বন্ড মাফিয়া-গডফাদারদের মূল ঘাঁটি গড়ে উঠেছে। এ দুটি এলাকায় প্রতিদিন গভীর রাতে ট্রাকে ট্রাকে খালাস হয় বন্ড সুবিধার আওতায় আনা কাপড়, প্লাস্টিক ও কাগজ-জাতীয় বিভিন্ন পণ্য। চোরাকারবারিরা এসব পণ্য বিক্রি করছে কালোবাজারে। রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি হওয়া পণ্যের এভাবে অবৈধ বাণিজ্যে ধ্বংস হচ্ছে দেশীয় শিল্প খাত। গত বছর ১৬ অক্টোবর গার্মেন্টস খাতের বন্ড মাফিয়া খ্যাত দেলোয়ার হোসেনকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বড় ঝাঁকুনিতে পড়ে। তাকে ছাড়ানোর ব্যাপারে সরকার ও প্রশাসনের এমন সব পর্যায় থেকে চাপ আসে যে চকবাজার থানা পুলিশ রীতিমতো ঘাবড়ে যায়। কিন্তু পুলিশের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা বন্ড ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সে থাকার কারণেই দেলোয়ার হোসেনকে হাজতবাস করানো সম্ভব হয়েছে। ইসলামপুরকেন্দ্রিক বন্ড মাফিয়া গোষ্ঠীর অন্যতম দেলোয়ার হোসেন ইতিমধ্যে শুল্ক গোয়েন্দা ও পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে বন্ড মাফিয়াদের দুর্বৃত্তপনার নানা তথ্য তুলে ধরেন। তার জবানবন্দিতেও বেরিয়ে আসে শীর্ষ মাফিয়াদের নাম। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেই মামলা ও জবানবন্দির সূত্র ধরে আর কোনো মাফিয়া গডফাদারকে গ্রেফতারের ব্যাপারে হাত বাড়ায়নি পুলিশ।

গত বছরের মাঝামাঝি সময়েও কাগজ খাতে শীর্ষ বন্ড মাফিয়া খ্যাত আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে শুল্ক গোয়েন্দারা অভিযানে নামতেই পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে। আবুল হোসেনের প্রভাব-প্রতিপত্তিতে অভিযানকারী গোয়েন্দাদের গোটা টিমকে ঢাকা ছাড়া হতে হয়েছে। তাদের কোনো কোনো সদস্য এখন অব্দি রয়েছেন চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে। সব ধরনের শিল্প ও ব্যবসায়ী খাতে সম্পৃক্তরা প্রায় সবাই নিজ নিজ খাতের বন্ড মাফিয়াদের নামধাম, অপকর্মের বিবরণ জানেন। কাস্টমস ও শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের একাধিক প্রতিবেদনে আছে তাদের বিস্তৃত পরিচয়। শুধু তাদের আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রেই নানা অদৃশ্য বাধা আটকে দেয় সবকিছু। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কারা সেই বন্ড মাফিয়া, তাদের নামধাম উল্লেখ করে ইতিমধ্যে একটি প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তাতে প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম, ঠিকানা, তারা কোন রাজস্ব দফতরের আওতায় রয়েছে, পাচার করা অর্থের পরিমাণ এবং ব্যবসার লাইসেন্স নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। এনবিআর কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত ৩৬ সদস্যের টাস্কফোর্স কমিটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে বিভিন্ন ব্যাংক, বন্দর, শুল্ক, ভ্যাট বা মূসক, আয়কর শাখাসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য জোগাড় করে এ প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে। প্রায় তিন বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে তথ্য সংগ্রহ শেষে পাঁচ মাস ধরে সে তথ্য যাচাই-বাছাই করার পর মাফিয়াদের পরিচিতি তুলে ধরে প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয় বলে জানা গেছে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর