বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

ঝুলছে দ্রুত বিচারের মামলাও

পাঁচ বছরের বেশি বিচারাধীন ৩২৮, স্থগিত ৬৬, ৯ ট্রাইব্যুনালে মামলা ৩১০৭

আরাফাত মুন্না

২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি। হবিগঞ্জের বৈদ্যেরবাজারে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা হয়। এ হামলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা শাহ এ এম এস কিবরিয়াসহ পাঁচজন নিহত হন। হত্যাকান্ডের ১০ বছর পর ২০১৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ হত্যাকান্ডের বিচার শুরু করে সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। আইন অনুযায়ী ১২০ কার্যদিবসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির বিধান থাকলেও আজও নিষ্পত্তি হয়নি চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি।

জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী খুন হন ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে। মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার ২ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। পরে উচ্চ আদালত এর ওপর স্থগিতাদেশ দেয়। অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের নিষ্ক্রিয়তায় ১৭ বছর ধরে ঝুলে আছে মামলাটি। 

দেশের নয়টি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে এমন তিন হাজারের বেশি মামলা ঝুলে আছে। এসব ট্রাইব্যুনালে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলছে প্রায় ৪০০ মামলা। আর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য পাঠানো ৬৬টি মামলার ওপর রয়েছে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ। আইনজ্ঞরা বলেন, বিচারে দীর্ঘসূত্রতা দেশের বিচার বিভাগের জন্য বড় সমস্যা হয়ে আছে। আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করা হলেও সাক্ষী না আসাসহ নানা কারণে এখানেও মামলা নিষ্পত্তির গতি কম। এর সঙ্গে রয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় কম ট্রাইব্যুনাল। এতে সাধারণ মানুষ আইনের প্রকৃত সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর দ্রুত বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনালে পাঠানো মামলাগুলো বছরের পর বছর স্থগিত থাকাটাও দুঃখজনক। তারা আরও বলেন, বিচার প্রার্থীদের জন্য দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সমস্যাগুলো খুঁজে বের করে সমাধান করতে হবে। এক্ষেত্রে নজরদারি বাড়াতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী (৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত), দেশের নয়টি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ৩ হাজার ১০৭টি মামলা বিচারাধীন ছিল। এর মধ্যে ঢাকার চারটি ট্রাইব্যুনালে ছিল ১ হাজার ৯৮৯টি মামলা। এ ছাড়া চট্টগ্রামে ১১০, রাজশাহীতে ১৪১, খুলনায় ৩৫৪, বরিশালে ৪৮৫ এবং সিলেটে নিষ্পত্তির অপেক্ষা ছিল ২৮টি মামলা। পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে বিচারাধীন আছে ৩২৮টি মামলা। আর উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে ৬৬টি মামলা। আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ২০০২ সালে প্রণয়ন করা হয় ‘আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন’। আর এ আইনের অধীনে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য একই বছর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইনও প্রণয়ন করে তৎকালীন সরকার। দ্রুত বিচার আইন প্রণয়নের সময় দুই বছরের জন্য আইনটি করা হলেও বিভিন্ন সময়ে এর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি এ আইনের মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বাড়িয়েছে বর্তমান সরকার। সংশোধিত আইনে মামলা নিষ্পত্তিতে বেঁধে দেওয়া হয়েছে ১২০ দিন। এই সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করা না গেলে কারণ উল্লেখ করে বিচারক আরও ৬০ দিন সময় বৃদ্ধি করতে পারবেন বলেও সংশোধিত আইনে উল্লেখ রয়েছে। আইন অনুযায়ী, দ্রুত বিচার আইনে দায়ের হওয়া মামলাগুলো ছাড়াও সরকার চাইলে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্যও এ ট্রাইব্যুনালে আনতে পারে। উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত হওয়া মামলাগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা সব সময়ই স্থগিত মামলা সচল করতে কাজ করছি। তবে অনেক সময়ই নিম্ন আদালতের আইন কর্মকর্তারা স্থগিতের তথ্যটা আমাদের জানান না। এর ফলে অনেক কিছুই করতে পারি না।

দ্রুত বিচার মামলা ঝুলে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও হাই কোর্ট বিভাগের স্পেশাল অফিসার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, বিচারাধীন মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের উদ্যোগ রয়েছে। স্থগিত মামলাগুলো নিষ্পত্তিতেও প্রধান বিচারপতির নির্দেশে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনেকদিন ধরে স্থগিত থাকা মামলাগুলো শুনানির জন্য হাই কোর্ট বিভাগের তিনটি বেঞ্চকে দায়িত্ব দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি।

কীভাবে সমাধান : দ্রুত বিচারের মামলায় দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিচার বিলম্ব হওয়া আমাদের বিচার বিভাগের অন্যতম একটি সমস্যা। বিচারে দীর্ঘসূত্রতার জন্য প্রধানত দায়ী সাক্ষী না আসা এবং বিচার কাজ মুলতবি হওয়া । রাষ্ট্রপক্ষের কাজ হবে যে কোনোভাবে সাক্ষী হাজির করা এবং মুলতবি ঠেকানো। তাহলেই মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে। বিচার প্রার্থীরা সুবিচার পাবে। তিনি বলেন, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলো দীর্ঘদিন স্থগিত থাকাটা দুঃখজনক। এসব মামলা সচল করতে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়কে উদ্যোগী হতে হবে।

এ বিষয়ে হাই কোর্টের সাবেক বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এ বি এম আলতাফ হোসেন মনে করেন, এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে সরকারের মনিটরিং খুব জরুরি। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের বিচারক স্বল্পতা রয়েছে এটা অস্বীকার করা যাবে না। একই সঙ্গে বিচার চলাকালে বার বার সমন দিয়েও সাক্ষীদের হাজির করা যায় না। সে ক্ষেত্রে বিচারক চাইলেও মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পারেন না। এসব সমস্যার সমাধানে দ্রুত বিচারের মামলাগুলোর ওপর সরকারের মনিটরিং আরও বাড়াতে হবে। আইনের সুফল পেতে সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর