রবিবার, ৩১ মে, ২০২০ ০০:০০ টা

‘সব বিক্রি করে টাকা পাঠাও, বাঁচাও’

প্রতিদিন ডেস্ক

সোনালি ভবিষ্যতের আশায় লিবিয়ায় গিয়ে মানব পাচারকারীদের হাতে আটকা পড়ে আহাজারি করেছেন বাংলাদেশের অনেক যুবক। তারা মুক্তিপণ হিসেবে পরিবারের কাছে ‘সবকিছু বিক্রি করে টাকা পাঠানো’র আকুতি জানান। প্রাণ বাঁচানোর দাবি ছিল তাদের।

মাদারীপুর থেকে আমাদের প্রতিনিধি বেলাল রিজভী জানান, মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার ইশিবপুর ইউনিয়নের ২৩ বছরের যুবক সজিব বেপারী মোবাইল ফোনে মায়ের কাছে আকুতি জানিয়েছে, ‘যা আছে সব বিক্রি করে টাকা পাঠাও। আমি বাঁচতে চাই। আমারে বাঁচাও। ওরা প্রতিদিন মারধর করে। কারেন্টে শক দেয়। মা আমি বাঁচতে চাই।’ কিন্তু এরপরও বাঁচতে পারেননি তিনি। সবকিছু বিক্রি করে দালালের কাছে টাকা দেওয়ার পরও সন্ত্রাসীদের গুলিতে প্রাণ হারান সজিব। শুধু সজিব নয়, মাদারীপুরের বিভিন্ন এলাকার এমন ১১ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ৪ জন। এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্বপ্ন পূরণের আশায় স্থানীয় দালালদের আশ্বাসে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন মাদারীপুরের বেশ কিছু যুবক। কিন্তু সেই আশার গুড়েবালি। তাদেরকে লিবিয়া নেওয়ার পর দালালরা জিম্মি করে দফায় দফায় টাকা দাবি করে। টাকা দিতে না পারলে দফায় দফায় চলে নির্যাতন। অনেকে আবার দাবিকৃত টাকা দিয়েও রক্ষা পাননি। স্থানীয় দালালদের কাছে টাকা দিলেও লিবিয়ায় অবস্থানরত মাফিদাদের কাছে টাকা না পৌঁছানোয় তাদের একপর্যায়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। নিহত ও আহতদের পরিবারের দাবি, মৃতদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হোক। দোষীদের শাস্তির দাবিও করেছেন ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। প্রশাসনও দালালদের শাস্তির আওতায় আনার চেষ্টা করছে। জানা গেছে, দুই দিন আগে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে করুণ আকুতি জানিয়েছিলেন সদর উপজেলার কুনিয়ার মনির আকন। তার কথা শুনে পরিবারও দালালদের দাবি করা ৭ লাখ টাকা সংগ্রহের চেষ্টা করছিল। কিন্তু এখন আর খোঁজ মিলছে না মনির আকনের। বিষয়টি জানাজানি হলে পরিবারের নেমে আসে শোকের ছায়া। কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা। মনিরের স্ত্রী মেরিনা বেগম বলেন, স্থানীয় দালাল নূর হোসেনের মাধ্যমে পাঁচ মাস আগে ইতালি যাওয়ার কথা বলে সে সাড়ে চার লাখ টাকা নিয়েছিল। এখন মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে গা-ঢাকা দিয়েছে নুর হোসেন। আমরা এর বিচার চাই। নিহত সজিব বেপারীর স্ত্রী নুরনাহার বেগম বার বার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার সন্তানের বয়স ৫ মাস। ও বাবার মুখটাও দেখেনি। সুখের আশায় দালালের প্রলোভনে পাড়ি জমিয়েছিল লিবিয়া। সেখানে দালালরা তাকে জিম্মি করে। প্রথম দফায় রেজাউল দালাল সাড়ে ৪ লাখ টাকা নেয়। পরে জিম্মি করে আরও ৫ লাখ টাকা নেয়। এরপর মাফিয়ারা তাকে গুলি করে হত্যা করে। সব টাকা দিয়েছি ধার দেনা করে। এখন কেমন করে এই দেনা পরিশোধ করব।’ স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশিসহ অভিবাসীদের মিজদা শহরের একটি জায়গায় টাকার জন্য জিম্মি করে রাখে মানবপাচারকারী চক্র। এ নিয়ে এক পর্যায়ে ওই চক্রের সঙ্গে মারামারি হয় অভিবাসী শ্রমিকদের। এতে এক মানবপাচারকারী মারা যায়। তারই প্রতিশোধ হিসেবে ২৮ মে রাত ৯টার দিকে ২৬ বাংলাদেশিসহ ৩০ অভিবাসী শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করে মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা। নিহতরা হলেন সদর উপজেলার জাকির হোসেন, জুয়েল হোসেন, ফিরোজ ও শামীম, রাজৈর উপজেলার বিদ্যানন্দী গ্রামের জুয়েল হাওলাদার, একই গ্রামের মানিক হাওলাদার (২৮), টেকেরহাট এলাকার আসাদুল, মনির হোসেন ও আয়নাল মোল্লা, ইশিবপুর এলাকার সজিব ও শাহীন। আহতরা হলেন- সদরের ফিরোজ বেপারী, ইশিবপুরের সম্রাট খালাসী ও কদমবাড়ীর মো. আলী।  কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, লিবিয়ায় গিয়ে মানব পাচারকারীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন কিশোরগঞ্জের ভৈরবের ৫ যুবক। এ ঘটিনায় গুরুতর আহত হয়েছেন ৩ জন এবং নিখোঁজ রয়েছেন ২ জন। গত বৃহস্পতিবার সকালে লিবিয়ায় এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে বলে নিহতদের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে। আহতরা লিবিয়ার ত্রিপোলীর কোনো এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ঘটনার পর থেকে প্রত্যেকের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। তাদের কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। অনেকেই বাড়িঘর, জমিজমা বিক্রি করে লিবিয়া হয়ে ইতালি যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মর্মান্তিক এ ঘটনায় তাদের পরিবারের সব স্বপ্ন ভেঙে গেল। নিহতরা হলেন ভৈরব উপজেলার রসুলপুর দক্ষিণপাড়া গ্রামের মীর আলীর ছেলে আকাশ মিয়া ওরফে সাদ্দাম (২৫), শম্ভুপুর বড়কান্দা গ্রামের মোকছেদ আলীর ছেলে মোহাম্মদ আলী (২৫), শ্রীনগরের বাচ্চু মিলিটারির ছেলে সাকিব (২০), কাঠবাজার ঋষিপাড়া এলাকার অধীর দাসের ছেলে রাজন চন্দ্র দাস (২৭), নিহত শাকিলের (২৫) ঠিকানা এখনো পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া শম্ভুপুর বড়কান্দা গ্রামের আবদুস সাত্তারের ছেলে জানু মিয়া (২৭), মৌটুপী গ্রামের আবদুল আলীর ছেলে সৌরভ আহমেদ সোহাগ (২২), জগন্নাথপুর গ্রামের সাফিল উদ্দিনের ছেলে সজল মিয়া (২০) গুরুতর আহত হয়ে ত্রিপোলীর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এ ছাড়া নিখোঁজ রয়েছেন আকবরনগরের জিন্নত আলীর ছেলে মাহবুবুর রহমান (২১) ও শম্ভুপুর বড়কান্দা গ্রামের লিয়াকত আলীর ছেলে মামুন মিয়া (২৬)।

ফরিদপুর প্রতিনিধি জানান, লিবিয়ায় মানবপাচারকারীদের গুলিতে নিহতদের মধ্যে ফরিদপুরের সালথা উপজেলার বল্লভদি ইউনিয়নের আলমপুরা গ্রামের কামরুল শেখ রয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন কামরুলের বড় ভাই ফারুক শেখ। নিহত কামরুল ওই গ্রামের কবির শেখের ছেলে। তার পরিবারে মা-বাবা, ৩ ভাই, ২ বোন, স্ত্রী ও আড়াই বছরের একটি পুত্র সন্তান রয়েছে। মর্মান্তিক এই মৃত্যুর খবরে নিহতের বাড়ি ও এলাকায় চলছে শোকের মাতম। স্বজন ও গ্রামবাসীরা  কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। নিহত কামরুলের পিতা কবির শেখ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘অভাব অনটনের সংসার। আশা ছিল ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে যদি একটু সুখের মুখ দেখতে পারি। সেই আশা নিয়ে দালালদের কথা মতো সমিতি থেকে লোন ও জমি বিক্রির সাড়ে চার লাখ টাকা জোগার করে গত ডিসেম্বর মাসে পাঠানো হয় বিদেশে। ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পাশাপাশি পরিবারের সচ্ছলতার কথা ভেবেই তাকে বিদেশ পাঠানোর তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু স্বপ্ন পূরণ তো দূরের কথা উল্টো লিবিয়া থেকে দালালরা ফোন করে ১০ লাখ টাকা দাবি করে আসছিল কিছুদিন ধরে।’ তিনি জানান, পাশর্^বর্তী গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর থানার গোয়ালা গ্রামের দালাল আবদুর রবের মাধ্যমে ভারত ও দুবাই হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছান কামরুল। নিহতের বড় ভাই ফারুক শেখ জানান, কামরুল লিবিয়া যাওয়ার পর থেকেই টাকার জন্য দালালচক্র লিবিয়ার একটি শহরে কামরুলকে আটকে রেখে নির্যাতন শুরু করে। তাদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে পাচারকারী চক্রটি। ভাইয়ের জীবনের কথা চিন্তা করে টাকা দিতে রাজিও হন তারা। কিন্তু টাকা পাঠানোর আগেই খবর এলো দালালচক্র লিবিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় মিজদা শহরে কামরুলসহ ২৬ বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করেছে।

সর্বশেষ খবর