যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে অপরাধপ্রবণ শিশু-কিশোরদের গায়ের জোরে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করায় উল্টো ফল হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এরই জের ধরে ছোট অপরাধীরা বড় অপরাধী হয়ে উঠছে এবং নানা অঘটন ঘটছে।
জানা গেছে, শিশু-কিশোরদের সঙ্গে কী রকম আচরণ করতে হবে, কীভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে- এসব বিষয়ে এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দায়িত্বরত অন্যদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই। প্রয়োজনের তুলনায় এখানে জনবলও অনেক কম। এখানে কার্যত ‘বন্দী’ শিশু-কিশোরদের বাড়ন্ত শরীরের জন্য পর্যাপ্ত খাবারও দেওয়া হয় না। তার ওপর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যক্তিগত কাজ ও আরাম-আয়েশের জন্য এসব শিশু-কিশোরকে কঠোর পরিশ্রম করানো হয়। সব মিলিয়ে এখানকার শিশু-কিশোরদের মন-মেজাজ সবসময় বিষিয়ে থাকে। ছোট ঘটনাতেও মুহূর্তেই বড় প্রতিক্রিয়া দেখায় তারা।
গত দুই দিন ধরে যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে বিভিন্নভাবে সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেছে, সমাজসেবা অধিদফতরের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত যশোরের এ প্রতিষ্ঠানটি গত এক দশক ধরেই দায়িত্বহীনতা, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও ত্রুটির মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়ে আসছে। জানা গেছে, এ কেন্দ্র থেকে ২০১১ সালের ২৯ আগস্ট আকাশ (১২) নামের এক কিশোরের গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। সে সময় বলা হয়েছিল, টিনের টুকরো দিয়ে নিজের গলা কেটে ওই কিশোর আত্মহত্যা করেছে। ২০১৯ সালের ৩০ জুন নূর ইসলাম (১৫) নামের আরও এক কিশোরের মরদেহ এখান থেকে উদ্ধার করা হয়। এটিও আত্মহত্যার ঘটনা বলে তখন জানানো হয়। এর আগে নিম্নমানের খাবার প্রদান ও নির্যাতনের অভিযোগে ২০১৪ সালের ৪ মে এখানকার শিশু-কিশোররা বিদ্রোহ করে বসে। গায়ের জোরে সেই বিদ্রোহ থামাতে গিয়ে পর দিন ৫ মে সেখানে থাকা পুলিশ-আনসার সদস্যদের সঙ্গে শিশু-কিশোরদের সংঘর্ষ হয়। কিশোররা কেন্দ্রের আসবাবপত্র ভাঙচুর করে ও ধারালো জিনিস দিয়ে নিজেদের শরীর কেটে রক্তাক্ত করে প্রতিবাদ করে। এরই মধ্যে ওই রাতে সেখান থেকে প্রায় ২০ ফুট উঁচু প্রাচীর টপকে নাজমুল ও নাইম নামে দুই কিশোর পালিয়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে, এ ঘটনার পর ওই কেন্দ্রে থাকা শিশু-কিশোরদের ওপর কর্তৃপক্ষ নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১০ মে আরও ৮ কিশোর এ কেন্দ্র থেকে পালিয়ে যায়, যাদের সবাই হত্যা মামলায় জড়িত হয়ে এখানে এসেছিল। এ ঘটনার পর যশোর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়ার পাশাপাশি বেশ কিছু সুপারিশও দিয়েছিল। প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে তিন কিশোরকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় আহত হয় আরও ১৫ কিশোর। প্রথম দিকে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তা বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, কেন্দ্রে থাকা কিশোররা দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে মারামারি করায় এ হতাহতের ঘটনা ঘটে। কিন্তু পরে আহত কিশোরদের বক্তব্য ও পুলিশের তদন্তে স্পষ্ট হয়, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মারপিটের কারণেই তিন কিশোর নিহত ও ১৫ কিশোর আহত হয়। পরে নিহত কিশোর রাব্বির পিতা রোকা মিয়া বাদী হয়ে যশোর কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের অজ্ঞাত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আসামি করা হয়। পরে পুলিশ কেন্দ্রের ১৯ কর্মকর্তা, কর্মচারী ও আনসার সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ওই কেন্দ্রের সহকারী পরিচালকসহ ৫ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে। সমাজসেবা কার্যালয় যশোরের তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা উপ-পরিচালক অসিত কুমার সাহা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এখন সমাজসেবার উপজেলা পর্যায়ের অফিস থেকে কর্মকর্তাদের এনে বাই রোটেশনে দায়িত্ব দিয়ে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র পরিচালনা করা হচ্ছে।’ কেন্দ্রের সাবেক সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিনও বলেন, কেন্দ্রে জনবল সংকট রয়েছে। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত শিশু-কিশোরদের নিয়ন্ত্রণে এখানে দায়িত্বরতদের হিমশিম খেতে হয়।