বুধবার, ১৯ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

অবকাঠামো নির্মাণ নদীর চরিত্র বুঝে : প্রধানমন্ত্রী

একনেকে ৭ প্রকল্প অনুমোদন সড়কে টোল আদায়ের নির্দেশনা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘নদীর চরিত্র বুঝতে হবে। জেনেশুনে অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। সব জায়গায় সবকিছু নির্মাণ করা যাবে না। ভাঙনের হুমকির মুখে থাকা নদীর পাড়ে নির্মিত স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা অবিলম্বে সরিয়ে নিন।’ গতকাল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনির্ধারিত আলোচনায় সংশ্লিষ্টদের এ নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া সড়কে টোল আদায় নিশ্চিত করা, স্লুইস গেট নির্মাণ না করার নির্দেশনাসহ দুই প্রকল্পের দুটি ডাকবাংলো তৈরির প্রস্তাবও কেটে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এদিকে ৩ হাজার ৪৬১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নতুন সাতটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে একনেক। এর মধ্যে সরকার দেবে ২ হাজার ৬১৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা, বিদেশি ঋণ ৫৮১ কোটি ২০ লাখ এবং বিশ্বব্যাংকের অনুদান ২৬০ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। গতকাল একনেক বৈঠক শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান।

রাজধানীর শেরেবাংলানগরের এনইসি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত একনেক বৈঠকে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে যুক্ত হন একনেক চেয়ারপারসন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান গণভবন এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও সচিবরা শেরেবাংলানগরের এনইসি মিলনায়তন থেকে একনেক বৈঠকে অংশ নেন। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘‘বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, ‘আমরা যে নদীর পাড়ে ঘরবাড়ি বানাই, তখন কি আমরা চিন্তা করি কোথায় বানাচ্ছি? বানিয়ে চলে গেলেন, নদী ভেঙে নিয়ে গেল। এটা ঠিক না। নদীর চরিত্র বুঝতে হবে। জেনেশুনে অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সব জায়গায় সবকিছু নির্মাণ করা যাবে না’।’’ পরিকল্পনামন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘মুন্সীগঞ্জে টিনের বাড়ি দোতলা দেখা যায়। সুন্দর সুন্দর একতলা, দোতলা। কারণ তারা পদ্মার পাড়ে বাস করত। পদ্মা ভাঙার সময় এলে তারা উঠিয়ে আরেক জায়গায় বসিয়ে দিতে পারবে।’ প্রধানমন্ত্রী আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, ‘আপনারা মডেল ডেভেলপ করুন। স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা, কলেজ যেগুলো হুমকির সম্মুখীন, সেগুলো আমরা যেন তাড়াতাড়ি সরিয়ে নিতে পারি, যাতে করে গোটা বিল্ডিং না খেয়ে ফেলে’।’’ এক প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, এ বিষয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হবে।

সড়কে টোল আদায়ের নির্দেশনা : একনেক সভায় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের তিনটি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সভার পর সড়কে টোল আদায় নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনার কথা জানান পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি বলেন, ‘এখানে (প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে) মন্তব্য এসেছে, সড়কে টোল বসানো। টোল সংযোজিত হবে। আমাদের রাস্তা বানাতে হবে। রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। মেরামত করতে হবে। মেরামত না করলে আপনারা সবাই বিরক্ত হন। টাকা লাগে তো। সুতরাং টোল করে সামান্য টাকা চাঁদা দিয়ে যাবেন। এটা উনি (প্রধানমন্ত্রী) মনে করেন, এটা বোধহয় ফ্রি হওয়া ঠিক নয়। আমি তার সঙ্গে শতভাগ একমত।’ এম এ মান্নান বলেন, ‘তিনি (প্রধানমন্ত্রী) আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন, এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য। টোল ফ্রি না করে টোল যেন নেওয়া হয়, যাতে কষ্টটা রিকভারি হয়। তবে টোলের সিস্টেমটা দ্রুত করতে হবে। গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে এক ঘণ্টা, এটা ঠিক নয়। এখন টেকনোলজি আছে, তাড়াতাড়ি নিয়ে নিতে হবে।’

ডাকবাংলো তৈরির প্রস্তাব কেটে দিলেন প্রধানমন্ত্রী : সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের দুটি প্রকল্পে দুটি ডাকবাংলো নির্মাণের প্রস্তাব ছিল। তবে সেই দুটি ডাকবাংলো প্রকল্প থেকে বাদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, ‘সড়কের প্রকল্পে ডাকবাংলো নয়। ডাকবাংলোর প্রয়োজন হলে সারা দেশে কতগুলো ডাকবাংলো লাগবে, এর জন্য আলাদা প্রকল্প নিয়ে আসতে হবে।’ ডাকবাংলো বাদ দেওয়ার বিষয়টি জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য তুলে ধরে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘‘এ প্রকল্পে (বারৈয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়ক প্রশস্তকরণ) একটা ইন্টারেস্টিং মন্তব্য আছে প্রধানমন্ত্রীর। একটা আইটেম ছিল রেস্ট হাউস (ডাকবাংলো) বানানোর। ৩ কোটি টাকার ওপরে একটা রেস্ট হাউস বানানোর প্রস্তাব ছিল। প্রধানমন্ত্রী বললেন যে, রেস্ট হাউস তো অনেক আছে। এটার কতটুকু প্রয়োজন তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সংশয় ছিল। তিনি বলেন, ‘আপনারা কাজ করেন, ঘোরেন। আপনাদের বিশ্রামের জায়গা অবশ্য প্রয়োজন। তাই তিনি বললেন, প্রকল্পের মধ্যে এ রকম একটা আইটেম না দিয়ে সারা দেশের যেখানে যেখানে প্রয়োজন, একটা প্রকল্প নিয়ে আসেন। আমি এক দিনেই অনুমোদন করে দেব।’ সুতরাং এটাকে তিনি কেটে দিয়েছেন।’’

স্লুইস গেট নির্মাণ না করার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর : দেশে আর স্লুইস গেট নির্মাণ না করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘একটা অনুশাসন প্রধানমন্ত্রীর আছে। আমি তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। স্লুইস গেটের জন্য আমার এলাকার মানুষও অস্থির হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীর অভিজ্ঞতা, বৃহদংশ স্লুইস গেট কাজ করে না। এগুলো নামলে ওঠে না, উঠলে নামে না। পানি উন্নয়ন বোর্ড যারা বানায়, এটা রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে তাদের যথাযথ স্টাডি নেই। প্রধানমন্ত্রীর আরেকটা পর্যবেক্ষণ, ইতিমধ্যে আগের তুলনায় দেশে পানির প্রবাহ কমে গেছে। ফারাক্কা বাঁধ, জলবায়ু ইত্যাদি কারণে এখন কম পানি যায়। মাঝেমধ্যে শক্তিশালী বন্যা হয়। সাধারণত কম পানি আসে। সুতরাং স্লুইস গেট বিশেষ দরকার নয় বলে মনে করেন তিনি। দেশে কত স্লুইস গেট বানানো হয়েছে, কয়টা চলছে এসব বিষয়ে স্টাডি করার জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে আদেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বন্যা শুধু বিপদ নয়, সম্পদও বটে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য তুলে ধরে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘বন্যা আমাদের পলি দেয়, বন্যার পানি ধুয়েমুছে ময়লা পরিষ্কার করে নিয়ে যায়। সুতরাং বন্যার সঙ্গে আমরা যেন অ্যাডজাস্ট (সমন্বয়) করে চলি। এটাকে যেন আমরা শত্রু না মনে করি। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের নদীগুলো ড্রেজিং করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। উপকূলের নদীগুলোর মুখ পরিষ্কার হলে পানি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাবে।’

সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সাত প্রকল্প অনুমোদন : নদী ভাঙন প্রতিরোধ, সড়ক প্রশস্তকরণ, সেতু নির্মাণ, মাছ আহরণ, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার বিষয়সহ নতুন সাতটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে একনেক। সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে এসব প্রকল্পে। একনেক বৈঠক শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, একনেক বৈঠকে অনুমোদিত প্রকল্পগুলো হচ্ছে- ১. তেঁতুলিয়া নদীর ভাঙন ঠেকাতে ৭১২ কোটি ২১ লাখ টাকা ব্যয়ে তেঁতুলিয়া নদীর ভাঙন থেকে পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার ধুলিয়া লঞ্চঘাট থেকে বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার ধর্মপাশা রক্ষা শীর্ষক প্রকল্প, ২. বারৈয়াহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্প, ৩. দাউদকান্দি-গোয়ালমারী-শ্রীরায়েরচর-মতলব উত্তর জেলা মহাসড়ক যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ প্রকল্প, ৪. খুলনা সড়ক জোনের অধীন মহাসড়কে বিদ্যমান সরু ও ঝুঁকিপূর্ণ পুরাতন কংক্রিট সেতু বা বেইলি সেতুর স্থলে কংক্রিট সেতু নির্মাণ প্রকল্প, ৫. গভীর সমুদ্রে টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মাছ আহরণে পাইলট প্রকল্প, ৬. কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্প এবং ৭. ইমারজেন্সি মাল্টি-সেক্টর রোহিঙ্গা ক্রাইসিস রেসপন্স (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্প।

সর্বশেষ খবর