রবিবার, ২৩ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

স্থবিরতা কাটাতে চায় কূটনৈতিক মিশন

করোনা সংকট দূর করতে নতুন পরিকল্পনা, কয়েকটি সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে প্রধানমন্ত্রীর চিঠি, গতানুগতিক কূটনীতি দিয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলা অসম্ভব বলছেন বিশ্লেষকরা

জুলকার নাইন

করোনাভাইরাসের মহামারী পরবর্তী ‘নিউ নরমাল ওয়ার্ল্ড’-এ নানামুখী চ্যালেঞ্জে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশের কূটনীতি। এমনিতেই ভ্যাকসিন কূটনীতি নিয়ে জটিলতা চলছে বিশ্বব্যাপী। ভ্যাকসিনের এই লড়াই শেষে বৈশ্বিক-আঞ্চলিক সম্পর্ক থেকে শুরু করে বাণিজ্য, শ্রমবাজার সবক্ষেত্রেই পড়তে হবে চ্যালেঞ্জে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গতানুগতিক কূটনীতি দিয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতি মোকাবিলা অসম্ভব। তাই এখনই কার্যকরী পরিকল্পনা ও উদ্যোগ না নিলে পিছিয়ে পড়বে দেশ। পরিস্থিতি বিবেচনায় স্থবিরতা কাটাতে নেওয়া হচ্ছে নতুন কূটনৈতিক মিশন। উদ্যোগী ইতিমধ্যেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দূতাবাসগুলোকে নতুন পরিস্থিতি মোকাবিলায় কয়েক দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেও রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে সরাসরি অনলাইন বৈঠকে নানান পরামর্শ ও নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি প্রতিটি দূতাবাসকে কর্মপরিকল্পনা জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিছু দূতাবাস থেকে পরিকল্পনা জমাও দেওয়া হয়েছে। শ্রমবাজারের সংকট মোকাবিলায় মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে পাঠানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর চিঠি।

জানা যায়, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্বজুড়েই লম্বা সময় ধরে সরাসরি কাজকর্মে স্থবিরতা ছিল। লকডাউন, কারফিউ বা সীমিত যোগাযোগের কারণে বন্ধ বা স্থগিত রাখতে হয়েছিল স্বাভাবিক কাজকর্ম। এই মহামারীতে সশরীরে কাজ করতে না পারলেও দূতাবাসগুলোর কাজ থেমে ছিল না। বিদেশ থেকে বাংলাদেশিদের ফেরত আনা ও বিপদগ্রস্ত বাংলাদেশিদের খাদ্য আর্থিক সহায়তার মতো কাজ করেছে দূতাবাসগুলো। কিন্তু রাজনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করা,  বহুপক্ষীয় জটিল দরকষাকষি অব্যাহত রাখা বা বিনিয়োগ আকর্ষণ করার মতো কাজগুলোতে ছিল স্থবিরতা।

কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও সাবেক কূটনীতিকরা বলছেন, করোনাকালে যৌক্তিক কারণেই কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্থরিবতা এসেছে। সরাসরি কাজ না করতে পারায় অনেক সাধারণ যোগাযোগও রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। এখন অত্যধিক মনোযোগী হতে হবে বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও বিনিয়োগ আকর্ষণের দিকে। এ ছাড়া বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আহরণের অন্যতম মাধ্যম শ্রমবাজারের বড় ক্ষতি করেছে করোনাভাইরাসের মহামারী। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পুরনো প্রায় প্রতিটি শ্রমবাজার। ফিরতে হয়েছে হাজারে হাজারে শ্রমিককে। কাজের ক্ষেত্রগুলোও সংকুচিত হয়েছে। শ্রমবাজার পরিস্থিতি আগের মতো অবস্থায় ধরে রাখতেও জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। পাশাপাশি নতুন শ্রমবাজার খোঁজাটাও জরুরি। পুরনো যারা চাকরি হারিয়েছে তাদের কাজের ব্যবস্থাও করতে হবে। তাই অসহায় পরিস্থিতিতে পড়া শ্রমিকরা যেন দূতাবাসগুলোতে কার্যকর সহায়তা পায় সে বিষয়গুলোও নিশ্চিত করতে হবে। দূতাবাসগুলোতে সাধারণ শ্রমিকদের সহায়তা না পাওয়া বা ভোগান্তির দুর্নাম দূর করে অনেক বেশি শ্রমবান্ধব হতে হবে। এ ছাড়া করোনা পরিস্থিতিতে ভুয়া কভিড সনদ কেলেঙ্কারিতে দুর্নামে পড়তে হয়েছে বাংলাদেশকে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের ইমেজ। এখনো বেশ কিছু দেশ এ কারণে বাংলাদেশিদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। তাই বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ইমেজ পুনরুদ্ধারের একটা বড় লড়াই আছে বাংলাদেশের কূটনীতির সামনে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সম্প্রতি যুক্তরাজ্য, ইতালি, ফ্রান্স, সুইডেন, বেলজিয়াম, গ্রিস, স্পেন, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ায় নিয়োজিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে এক ভার্চুয়াল সভায় অংশ নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের সব বৈদেশিক দূতাবাসে হাসিমুখে সেবা দিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছেন। রাষ্ট্রদূতদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যে কোনো ধরনের কর্তব্যে অবহেলা, সেবা দিতে অনীহা এবং অসৌজন্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সব দূতাবাসে সেবার গুণগত মান বাড়ানোর জন্য মিশনের হটলাইন ২৪ ঘণ্টা চালু রাখাসহ সেবাগ্রহীতাদের সমস্যা ও অভিযোগ শুনে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। মিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ফোন ধরেন না বা সেবা দিতে অনীহা প্রকাশ করে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে মিশনপ্রধানদের। এ ছাড়া করোনা মহামারীর কারণে সৃষ্ট বিশ্ব পরিস্থিতিতে দেশের রপ্তানি আয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে তৈরি পোশাক শিল্পের বর্তমান বাজার সংরক্ষণের পাশাপাশি নতুন বাজার অনুসন্ধানের জন্য ইউরোপে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের প্রতি নির্দেশনা দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। একই ধরনের আরেকটি ভার্চুয়াল সভা করা হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করা বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে প্রবাসী শ্রমিকদের ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য থাকা কূটনৈতিক চাপ মোকাবিলার কৌশল ও উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে। বিভিন্নমুখী কূটনৈতিক উদ্যোগের মধ্যে কয়েকটি সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে প্রধানমন্ত্রীর চিঠি পৌঁছানো ও পরবর্তী ফিডব্যাক সংগ্রহের নিদেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় যৌথভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের কথা বলা হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রদূতদের। পাশাপাশি নতুন শ্রমবাজার খোঁজার জন্য রাষ্ট্রদূতদের প্রতি অনুরোধ করেন। দুই সভাতেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের বিপক্ষে নেতিবাচক প্রচারণার বিষয়েও রাষ্ট্রদূতদের সতর্ক থাকার অনুরোধ করেন।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবিরের মতে, মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশগুলোতেই বাংলাদেশের প্রায় ৮০ ভাগ শ্রমিক কাজ করে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর আগেই তেলের দাম কমার কারণে এই দেশগুলোতে শ্রমবাজারের সংকট শুরু হচ্ছিল। তখন সংকট শুরু হলেও প্রকট হয়নি। কারণ তখন কম করে হলেও শ্রমিকদের যাওয়ার প্রবাহটা ছিল। কিন্তু কভিড-১৯ আসার পরে অনেক দেশেরই অর্থনীতি বন্ধ করে রাখতে হয়েছিল। ফলে তেলের দাম কমে যাওয়া ও লকডাউন একসঙ্গে পরিস্থিতিকে জটিল করেছে। তিনি বলেন, কভিড পরবর্তী অর্থনৈতিক বিশ্বের শ্রমবাজারের জন্য বাড়তি প্রস্তুতির প্রয়োজন হবে। কারণ অদক্ষ শ্রমিকদের কাজে পাঠানোর সুযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো যে দেশগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অদক্ষ শ্রমিক পাঠায় তাদের শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে যেতে পারে। এখন ফেরত আসা শ্রমিকরা যে লেভেলের দক্ষতায় কাজ করত, তাদেরকে যদি এর চেয়ে উপরের লেভেলের দক্ষতায় নেওয়া সম্ভব হয়। তাহলেই কেবল তাদের জন্য কাজের সুযোগ থাকবে। হুমায়ূন কবির বলেন, শ্রমবাজারের সংকট মোকাবিলায় সত্যিকার উদ্যোগ নিতেই হবে। কারণ এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের ৭-৮ শতাংশই আসে এই প্রবাসী আয় থেকে। আর রেমিট্যান্স হিসেবে যে টাকাটা আমরা পাই, সেটা একেবারেই নেট গেইন হিসেবেই আসে। দক্ষতার বৃদ্ধি করা সম্ভব হলেই কেবল আমরা পরিবর্তিত প্রযুক্তিনির্ভর ও জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতিগুলোতে আমাদের শ্রমশক্তি পাঠাতে পারব। তখন রেমিট্যান্সের পরিমাণের ক্ষেত্রেও বড় পরিবর্তন আসবে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব এ কে এম আতিকুর রহমানের মতে, তিনটি ক্ষেত্রের লোকজনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কূটনীতি পরিচালনা করা যেতে পারে। ক. বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে কর্মরত কূটনীতিকরা, খ. বাংলাদেশে বিনিয়োগ-সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কর্মরত সরকারি কর্মকর্তারা এবং গ. বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ক সংগঠনের বা প্রতিষ্ঠানের নেতা ও শিল্পপতিরা। বাংলাদেশ থেকে কাজ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশি দূতাবাসগুলোও ওইসব দেশ থেকে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার মাধ্যম হতে পারে। কখনো কখনো বাংলাদেশে বসে বিভিন্ন উপায়ে অর্থনৈতিক কূটনীতি অনুশীলন বিদেশে আমাদের দূতাবাসের চেয়ে আরও শক্তিশালী, সহজতর এবং ফলপ্রসূ হতে পারে। বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী নেতাদের ব্যক্তিগত সংযোগ হতে পারে অর্থনৈতিক কূটনীতি সম্পাদনের আরেকটি কার্যকর উপায়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর