রবিবার, ২৩ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনায় মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ পেতে পুনর্বিবাহ না করার শর্ত!

পুনর্বিবাহ না করার অঙ্গীকারনামা দিয়ে ক্ষতিপূরণের অর্থ পেতে আবেদন করেছেন উপপুলিশ কমিশনার মিজানুরের স্ত্রী

মানিক মুনতাসির

সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী কভিড-১৯ আক্রান্তদের সেবা দিতে গিয়ে কিংবা সরাসরি এ-সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত থাকাবস্থায় কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে সরকারি ক্ষতিপূরণ হিসেবে মৃতের পরিবার  ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত পাবে। ২৩ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট শাখা থেকে এ-সংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারি করা হয়। সে অনুযায়ী কভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া দুজন সরকারি চাকুরের পরিবার ৫০ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। এদের একজন চিকিৎসক মো. মঈন উদ্দীন ও অন্যজন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরীর পরিবার। তবে বিপত্তি বেধেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে কর্মরত অবস্থায় করোনায় মৃত্যুবরণ করা উপকমিশনার মিজানুর রহমানের পরিবারের ক্ষেত্রে। মিজানুর রহমানের স্ত্রীর কাছে পুনরায় বিবাহ না করার অঙ্গীকারনামা চেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তিনি এই অঙ্গীকারনামা দিয়েছেনও। তবে মিজানুর রহমানের পরিবারের একাধিক সদস্যের দাবি, এটা তাদের ওপর জোর করে নেওয়া হয়েছে। এখানে মজার ব্যাপার হলো, ডা. মঈন উদ্দীন ও সিনিয়র সচিব আবদুল্লাহ আল মোহসীন চৌধুরীর পরিবারের কাছে এ-সংক্রান্ত কোনো অঙ্গীকারনামা চাওয়া হয়নি। এটাকে একটা বৈষম্যমূলক আচরণ ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ বলে মনে করছেন নারীনেত্রীরা। শুধু তা-ই নয়, এতে তারা বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, রাষ্ট্রযন্ত্র কখনো কারও ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এটা চরম অন্যায়।

সূত্র জানায়, ১৩ জুলাই করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজারবাগের কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে মারা যান  পুলিশের উপকমিশনার মিজানুর রহমান। এরপর তার পরিবারের পক্ষ থেকে মিজানুরের স্ত্রী ক্ষতিপূরণের আবেদন করেন সার্কুলার মেনে। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে পুনর্বিবাহ না করার অঙ্গীকারনামা চাওয়া হয়। অন্যথায় ক্ষতিপূরণের অর্থ পেতে সমস্যা হবে বলে জানানো হয়। এ জন্য মিজানুরের স্ত্রী অঙ্গীকারনামা দাখিল করেন। এখনো তার সেই ক্ষতিপূরণ বা দাবিনামা নিষ্পত্তি হয়নি। তবে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এটা চূড়ান্ত পর্র্যায়ে রয়েছে, যে কোনো দিন তিনি চেক পেয়ে যাবেন।

এদিকে পুনর্বিবাহ না করার অঙ্গীকারনামার ব্যাপারে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চাকরিরত অবস্থায় কোনো সরকারি চাকুরে মারা গেলে তার পরিবারের পেনশনপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে এটার প্রয়োজন হয়। কেননা ভিকটিমের স্ত্রী অন্য কোথাও পুনরায় বিয়ে করলে তার উত্তরসূরি বা সন্তানদের পেনশনপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সে জন্য পুনর্বিবাহ না করার অঙ্গীকারনামার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু কভিড আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার ক্ষেত্রে এর কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। কেননা এটা একটা এককালীন সহায়তা। তবু অর্থ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এটা নিয়েছে মিজানুরের পরিবারের কাছ থেকে। সেটা নিশ্চয়ই ঠিক হয়নি বলে মনে করেন অর্থ বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা। মিজানুর রহমানের এক নিকটাত্মীয় বিষয়টি বিব্রতকর বলে জানান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিষয়টা খুবই অবমাননাকর। আমি হতভম্ব। আমি বিস্মিত। বিবাহ করা না করা হচ্ছে ব্যক্তিস্বাধীনতা। এখানে রাষ্ট্রযন্ত্র কাউকে বাধ্য করতে পারে না। এটা খুবই দুঃখজনক। আশা করি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টির একটা সুষ্ঠু সমাধান করবেন। কেননা তিনি নিজেই একজন নারী।’ আর নারী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী মালেকা বেগম বলেন, ‘এটা তো রীতিমতো অন্যায়। ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। এ ধরনের আচরণ রাষ্ট্র কিংবা প্রতিষ্ঠান কেউ কারও সঙ্গে করতে পারে না।’ সূত্র জানায়, আজ রবিবার অর্থ বিভাগ প্রধান হিসাবরক্ষকের মাধ্যমে মিজানুর রহমানের পরিবারের কাছে ৫০ লাখ টাকা অনুমোদনের জন্য চিঠি দেওয়ার কথা রয়েছে। এর আগে ২৩ জুলাই যুগ্ম-সচিব মোহাম্মদ আবু ইউসুফ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়েছে, অর্থ বিভাগের ড্রয়িং ও ডিসচার্জিং অফিসার (ডিডিও) কভিড ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণের চেক হস্তান্তর করবেন। চিঠিতে অর্থ বিভাগের নতুন শর্ত রয়েছে, করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত বিধবাকে পুনরায় বিয়ে না করার জন্য একটি বন্ডে স্বাক্ষর করতে হবে। সে অনুযায়ীই পুনর্বিবাহ না করার অঙ্গীকারনামা দিয়েছেন মিজানুর রহমানের স্ত্রী।

এদিকে জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ফয়জুল হাকিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ক্ষতিপূরণ অবশ্যই মৃত ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীলদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। কিন্তু মিজানুর রহমানের স্ত্রীর কাছে পুনর্বিবাহ না করার যে অঙ্গীকারনামা নেওয়া হয়েছে, সেটি খুবই অমানবিক। এটি আমলাদের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের প্রকাশ।

 

সর্বশেষ খবর