মঙ্গলবার, ২৫ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

ঝুলেই আছে রোহিঙ্গা সংকট

তিন বছরে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় নেই ন্যূনতম অগ্রগতি । আন্তর্জাতিক কূটনীতির জটিলতায় আলোচনাই বন্ধ । পরিস্থিতি আরও জটিল বলছে জাতিসংঘ । ছড়িয়ে পড়ছে দেশজুড়ে, জড়াচ্ছে অপরাধে

জুলকার নাইন

ঝুলেই আছে রোহিঙ্গা সংকট

কক্সবাজারের উখিয়ার জামতলী রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প। ২৩ আগস্ট তোলা ছবি -এএফপি

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার তিন বছর পরও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। রোহিঙ্গাদের দেখতে একের পর এক বিদেশিরা এলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। দ্বিপক্ষীয়-বহুপক্ষীয় কোনো আলোচনাতেই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। বরং আন্তর্জাতিক কূটনীতির জটিলতায় এখন প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে আলোচনা ও উদ্যোগ। শুরু থেকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে দেনদরবার করা জাতিসংঘ এখন বলছে, পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া এই সাড়ে ৮ লাখ রোহিঙ্গা এখনো গলার কাঁটাই হয়ে রয়েছে। ক্যাম্প ও ক্যাম্পের বাইরে তারা জড়াচ্ছে নানামুখী অপরাধে, কেউ কেউ ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কূটনৈতিক ও প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা বলছেন, তিন বছর আগে মানবতার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেই সীমান্ত খুলে দিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার। সেদিন থেকে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতে সাধ্যের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের কোষাগার থেকে রোহিঙ্গাদের পেছনে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১ লাখ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের আশ্রয়ের জন্য আসা রোহিঙ্গাদের আরও ভালো থাকার সুযোগ সৃষ্টির জন্য শত শত বিদেশি সংস্থাকেও কাজ করার অবারিত স্বাধীনতা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ায় নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অভিযোগ ওঠে বিভিন্ন সময়। পাশাপাশি রোহিঙ্গা কূটনীতি নিয়েও আন্তর্জাতিক তৎপরতায় অস্থায়ী ক্যাম্প চিরস্থায়ী হচ্ছে বলেও অভিযোগ এসেছে। জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে তারা এসে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয় শিবিরে বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ নিবন্ধিত রোহিঙ্গা আছে। তাদের ফেরত পাঠাতে গত বছরের ২২ আগস্ট সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। কিন্তু তারা যেতে না চাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। এর আগে ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বরও আরেক দফা প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিক্ষোভ-সমাবেশের কারণে সে দফায়ও প্রত্যাবাসন ভ-ুল হয়ে যায়। দুই দফাতেই শুধু মুখের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ করেই নিজ দেশে ফিরে যাওয়া থেকে বেঁচে যাওয়া ও সেজন্য কোনো ধরনের চাপ অনুভব না করা রোহিঙ্গারা যারপরনাই খুশি। এর পর থেকে গত এক বছরে নতুন কোনো প্রত্যাবাসন উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। গত বছরের ১১ নভেম্বর মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মামলা করে গাম্বিয়া। সে মামলায় হেগ শহরে আইসিজের শুনানিতে মিয়ানমারের পক্ষে লড়তে হাজির হয়েছিলেন অং সান সুচি। কিন্তু সে মামলার পরও কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। বরং চলতি বছর নতুন করে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিভিন্ন কথা ঘুরছে ক্যাম্পের সবার মুখে মুখে। গত ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী জানায়, ২০১৭ সালে আরও দুই রোহিঙ্গা গ্রামে নির্যাতনের অপরাধে দায়ী সেনাদের কোর্ট মার্শাল করা হবে। কিন্তু তারও কোনো প্রতিফল পরে আর দেখা যায়নি। বরং সর্বশেষ এপ্রিলে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা বহরে যোগ হয় সমুদ্রে ভাসমান থাকা আরও ৩৯৬ রোহিঙ্গা।

কূটনৈতিক সূত্রের খবর, আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি ও নানামুখী স্বার্থের কারণেই আটকে গেছে রোহিঙ্গা সংকট। চীনের কারণে শুরু থেকেই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে গত বছর বাংলাদেশ-চীন শীর্ষ বৈঠকে সহযোগিতার আশ্বাস এলেও তার কোনো প্রতিফলনই দেখা যায়নি। চীন সরাসরি আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের বাইরে নিজেদের মধ্যে সমাধানের কথা বলছে। গত তিন বছরে চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু ফেরত পাঠানো যায়নি একজনকেও। গত এক বছরে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে তেমন কোনো আলোচনাও হয়নি। আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তি প্রতিবেশী ভারতের কাছে বাংলাদেশ বিভিন্ন সময় অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আশ্বাস পেলেও ভারত এখন পর্যন্ত এ ইস্যুতে বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি। অনেক ক্ষেত্রে তারা ভোটদানে বিরত থাকলেও বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দেয়নি। শুরু থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সোচ্চার পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি ছাড়া প্রত্যাবাসনের বিপক্ষে। পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো বরং বাংলাদেশকে আরও কিছু বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। আর পরিবেশ সৃষ্টির বিষয়ে কোনো গা করছে না মিয়ানমার।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা-ইউএনএইচসিআর সর্বশেষ বিবৃতিতে বলেছে, তিন বছর পর আজও বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ আছে ও নতুন অনেক চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ মহামারী পরিস্থিতিকে করেছে আরও জটিল। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও স্থানীয় বাংলাদেশি জনগণকে সাহায্যের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত পরিবর্তিত পরিস্থিতির নতুন চাহিদাগুলো মেটানো এবং এ সংকট সমাধানের লক্ষ্যে আরও বেশি কাজ চালিয়ে যাওয়া। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘রোহিঙ্গাদের হিসাবে তাদের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ আজ মিয়ানমারের বাইরে আছে। ইউএনএইচসিআর ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ নিবন্ধন অনুযায়ী কক্সবাজারে অবস্থান করছে প্রায় ৮ লাখ ৬০ হাজার রোহিঙ্গা। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিবন্ধিত প্রতি ১০ জন রোহিঙ্গার মধ্যে নয়জন বাস করে বাংলাদেশে। এ মহানুভবতার প্রতিদান হিসেবে রোহিঙ্গা শরণার্থী ও স্থানীয় বাংলাদেশি জনগণের জন্য নিরন্তর সহায়তা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। ইউএনএইচসিআর জানায়, রোহিঙ্গা সংকটের পরিপূর্ণ সমাধান আছে মিয়ানমারে। রাখাইন রাজ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিশনের সব সুপারিশ পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমেই এটি সম্ভব; আর মিয়ানমার সরকারও সেটি করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

কক্সবাজারে কর্মরত ৫০টি স্থানীয় ও জাতীয় এনজিওর ফোরাম-সিসিএনএফ বলছে, ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনে লেগেছিল ১০ বছর। এ মুহূর্তে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন শুরু হলেও তা সম্পন্ন হতে এক দশকের বেশি লাগবে। তাই এ বিশাল জনগোষ্ঠীকে অলস অবস্থায় রাখা উচিত নয়, মানবিক মর্যাদার সুবিধার্থে তাদের জন্য সহজে বহন ও স্থানান্তরযোগ্য ঘর, শিক্ষা ও উপার্জনমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত।

পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছেন, দুবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সফল হয়নি। কারণ, রোহিঙ্গারা ফেরত যেতে ভয় পাচ্ছে। আর রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের ভিতরে নিয়ে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ ধরনের কোনো চিন্তাও বাংলাদেশ করছে না। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের জন্য বড় ধরনের কোনো বিনিয়োগও বাংলাদেশ চায় না। কারণ, এর ফলে রাখাইন থেকে রোহিঙ্গারা দলে দলে আবার বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে উৎসাহিত হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ কোর্ট ও আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে এ সংকটের বিচার প্রক্রিয়া চলছে। বাংলাদেশ মনে করে এ সংকটের সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর