মঙ্গলবার, ২৫ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

আইন সংস্কার নিয়ে খোদ ইসিতেই ভিন্নমত

কমিশন সভায় আবার নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার

গোলাম রাব্বানী

আইন সংস্কার নিয়ে খোদ ইসিতেই ভিন্নমত

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ও স্থানীয় সরকার আইন সংস্কার নিয়ে খোদ নির্বাচন কমিশনেই ভিন্নমত তৈরি হয়েছে। আরপিও এবং স্থানীয় সরকার আইনের সংস্কারের বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে কমিশন বৈঠকে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পদ ও পদবি পরিবর্তন সংক্রান্ত প্রস্তাবনার ভিন্নমত পোষণ করেন তিনি। অন্য তিন কমিশনারও স্থানীয় সরকার আইন সংস্কারে ইসির এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারাও ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন।

গতকাল ‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন পরিচালনা আইনের খসড়া অনুমোদন ও বিবিধ’ বিষয়ে সিইসি কে এম নূরুল হুদার সভাপতিত্বে কমিশন সভা অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন কমিশনের ৬৯তম সভায় এ সংক্রান্ত ‘নোট অব ডিসেন্ট’ প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য নির্বাচন কমিশনারদের হাতে তুলে দেন মাহবুব তালুকদার। তিনটি বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করে দেওয়া এই ‘নোট অব ডিসেন্ট’-এর একটি কপি বাংলাদেশ প্রতিদিনের সংগ্রহে রয়েছে।

বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, মাহবুব তালুকদারের ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়া ছাড়া স্থানীয় সরকার আইন সংস্কার নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন কথা বলেছেন অন্যান্য নির্বাচন কমিশনাররাও। একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, স্থানীয় সরকার আইন সংস্কারে ইসির এখতিয়ার আছে কি না সেটাও দেখা উচিত। অপর একজন বলেছেন, আইন হলে আমরা নির্বাচন পরিচালনার জন্য বিধিমালা করতে পারি। আরেকজন বলেছেন, আমরা স্থানীয় সরকার আইন সংস্কার করব। এ জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় আমাদের লিখিত দেক।  এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ কমিশন সভায় পড়ে শুনিয়েছি। সিইসিসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের হাতে তুলে দিয়েছি। ২০১৭ সালে পাঁচ সদস্যের বর্তমান কমিশন যোগ দেওয়ার পর বেশ কয়েকবার ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেন তিনি। এবং একবার সভা বর্জন করেছিলেন।

ইসি নখ দন্তহীন বাঘ নয়, বিড়ালে পরিণত হবে :  স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নাম-পদবি পরিবর্তন; গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশকে আইনের প্রতিস্থাপন ও প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা থেকে সরে আসার বিষয়ে ভিন্ন মত দিয়ে সভায় আন-অফিশিয়াল নোট দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তিনি বলেছেন, আমি নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাব সম্পর্কে তিনটি বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছি। ‘নোট অব ডিসেন্ট’ তিনি লিখেছেন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো, মেয়াদকাল ইত্যাদি পরিবর্তন নির্বাচন কমিশনের কর্তব্য নয়। বিশেষত স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন পদ ও পদবি পরিবর্তন নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার নয়। এই সংস্কার কার্যক্রম নিতান্তই স্থানীয় সরকারের বিষয়। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন পরিচালনা আইনের যে সংস্কারের যে প্রস্তাব করেছে, আমি তার সঙ্গেও একমত নই। কেবল নির্বাচন পরিচালনার জন্য ভিন্ন আইন হতে পারে না, তা সার্বজনীন হতে হবে।

‘নোট অব ডিসেন্ট’ তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের ২৪ আগস্ট ২০২০ তারিখের অনুষ্ঠিত ৬৯তম সভায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন পরিচালনা আইনের খসড়া অনুমোদনের জন্য পেশ করা হয়েছে। এই খসড়ায় ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২’ রহিতপূর্বক সংশোধনসহ ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আইন, ২০২০’ প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। আমি এই উদ্যোগের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করি। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের তৃতীয় অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২’ প্রণয়ন ও জারি করেন। এটি একটি ঐতিহাসিক আইনগত দলিল, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনন্য স্মারক। কী কারণে বা কোন যুক্তিতে এই পরিবর্তন প্রয়োজন, তা আমার বোধগম্য নয়।

তিনি বলেন, আরপিও বা ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২’-এর ৯১ই ধারায় কোনো প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলের সরাসরি ক্ষমতা, যা নির্বাচন কমিশনের কাছে ন্যস্ত ছিল, তার বিলোপ সাধন। এই ধারাটি সব রাজনৈতিক দলের সম্মতিতে আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। রকিবউদ্দীন কমিশন এটি বাতিলের উদ্যোগ নিয়ে চরম সমালোচনার মধ্যে পড়ে এবং পরে ওই উদ্যোগ থেকে সরে আসে।

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ইতিপূর্বে ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২’ রহিত করে ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আইন ২০২০ বিল’ -এর খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। আইন মন্ত্রণালয়ের মতে এই প্রস্তাবে ১১টি মৌলিক ও পদ্ধতিগত বিধান বাদ দিয়ে খসড়াটি তা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।

এতে সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, প্রার্থিতা সরাসরি বাতিলের একক ক্ষমতা থেকে সরে আসা নির্বাচন কমিশনের একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলে মনে করি। এতে নির্বাচন কমিশন নখ দন্তহীন বাঘ নয়, বিড়ালে পরিণত হবে। আমি এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জ্ঞাপন করছি। আমার মতে প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা এককভাবে সরাসরি নির্বাচন কমিশনের কাছে থাকা আবশ্যক।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর