বুধবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ঢেলে সাজানো হচ্ছে কারাগারের নিরাপত্তা

সাখাওয়াত কাওসার

মহামারী করোনা মোকাবিলায় সফলতা দেখালেও এক মাসে দুই দফা বন্দী পলায়নের ঘটনায় বিব্রত কারা প্রশাসন। যে কোনো মূল্যে এসব অনিয়ম ঠেকাতে ঢেলে সাজানো হচ্ছে কারাগারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এরই মধ্যে কারা সদর দফতর থেকে ৮টি বিশেষ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বিশেষ চিঠি পাঠানো হয়েছে সব কটি কারা বিভাগ ও দেশের ৬৮টি কারাগারে। শুধু তা-ই নয়, নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখতে কারা মহাপরিদর্শক ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক দফায় দফায় ‘ভার্চুয়াল মিটিং’ করছেন কারা কর্মকর্তাদের সঙ্গে।

জানা গেছে, গতকাল বেলা ২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র সচিব (সুরক্ষা) মো. শহিদুজ্জামান এবং কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মোস্তফা কামাল পাশা টানা দুই ঘণ্টাব্যাপী ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ বিভাগের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন), সিনিয়র জেল সুপার ও জেল  সুপারদের সঙ্গে ভার্চুয়াল মিটিং করেছেন। আগামী ৩ সেপ্টেম্বর তারা রাজশাহী, যশোর, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের জেল সুপার থেকে ডিআইজি প্রিজন পর্যন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করবেন স্বরাষ্ট্র সচিব ও আইজি প্রিজন। এদিকে ৬ আগস্ট কাশিমপুর-২ থেকে মই বেয়ে যাবজ্জীবন দ-প্রাপ্ত কয়েদি আবু বক্কর ছিদ্দিক পালিয়ে গেলেও গতকাল পর্যন্ত তাকে আটক করা যায়নি। কয়েদির পোশাক না থাকায় বেলা সোয়া ১১টার দিকে কারারক্ষীদের সামনে দিয়েই মই নিয়ে গেলেও কেউ বাধা দেননি তাকে এমন তথ্য উঠে এসেছে তদন্ত প্রতিবেদনে। তদন্ত কমিটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, ৪২ জন কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাক্ষ্য ও অন্যান্য নথি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন তৈরি করে। সিনিয়র জেল সুপার জাহানারা বেগমসহ ২০ জন কারা সদস্যের দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পেয়েছে কমিটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেলা ১২টা ২০ মিনিটে মই পড়ে থাকতে দেখে একজন কারারক্ষী মইটি কয়েদি গোয়েন্দা জাকিরকে দিয়ে কেস টেবিলে পাঠান। সে সময় কেস টেবিলে সর্বপ্রধান কারারক্ষী বসা ছিলেন। গতকাল পর্যন্ত জেল পলাতক কয়েদি আবু বক্কর ছিদ্দিককে গ্রেফতার করতে পারেনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। এর মাত্র ২২ দিন পর ২৮ আগস্ট রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে মিন্টু মিয়া নামের এক বন্দী পালিয়ে যান। তবে পরদিনই তাকে আটক করেন কারারক্ষীরা। এ ঘটনায় কারা কর্তৃপক্ষ দায়িত্বে অবহেলার কারণে সহকারী প্রধান কারারক্ষী মোবারক, কারারক্ষী আবুল কালাম ও আলিমকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কারা অধিদফতরের অতিরিক্ত আইজি প্রিজন কর্নেল আবরার হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রতিটিই অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা। তবে এসব স্পর্শকাতর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে আমরা অত্যন্ত সতর্ক। এরই মধ্যে দেশের সব কটি কারাগারে বিশেষ নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এতে কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘এখনো পর্যন্ত দর্শনার্থী সাক্ষাৎ বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে সপ্তাহে এক দিন বন্দীরা তাদের স্বজনদের সঙ্গে ৫ মিনিট করে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন। এ ছাড়া করোনার বিষয়ে আমরা আগের মতোই সতর্ক এবং সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছি।’

জানা গেছে, কারা অধিদফতর থেকে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে, কোনো কোনো কারাগারে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা, এমনকি বন্দী পলায়নের ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে, যা চরম প্রশাসনিক দুর্বলতার নামান্তর এবং মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারাগার একটি স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান। বন্দী পলায়নসহ যে কোনো দুর্ঘটনা রোধকল্পে কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করা আবশ্যক। কিন্তু কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে সক্রিয় না হওয়ায় বন্দী পলায়নসহ বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে, যা সুষ্ঠু কারা প্রশাসনের অন্তরায় এবং কারা বিভাগের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণœ হয়েছে। অতএব বন্দী পলায়নসহ যে কোনো দুর্ঘটনা রোধপূর্বক কারা নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য সব কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সর্বোচ্চ অধিক সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো।

আইজি প্রিজন স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, কারাবিধি যথাযথভাবে অনুসরণপূর্বক নিয়মিত কেস টেবিল কার্যক্রম পরিচালনা করা, ফাইলে নিয়মিত অংশগ্রহণ, নৈশ পরিক্রমা, বন্দী দরবার সম্পন্ন করা, কারাগারে নিষিদ্ধ দ্রব্যের অনুপ্রবেশ বন্ধ করা, কারা অভ্যন্তরে গমনকারী পিআইইউর সদস্য এবং সিভিল কর্মচারীসহ সবাইকে যথানিয়মে তল্লাশিকরণ এবং সিসিটিভি মনিটরিং ও অন্যান্য নিরাপত্তা-সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সব কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করে কারাগারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো। কোনো কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীর দায়িত্ব পালনে ন্যূনতম ব্যত্যয় বা শিথিলতার প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

কারা সূত্র বলছে, দীর্ঘ দিন ধরে নজরদারি ও জবাবদিহির অভাবে কারা সদস্যদের মধ্যে এক ধরনের শিথিলতা চলে আসছিল। এসব কারণে অনেক তথ্য সম্পর্কে অন্ধকারেই থেকে যায় কারা অধিদফতর কিংবা সরকারের উচ্চপর্যায়।

তবে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব বিষয়ের উত্তরণ ঘটাতে বন্দী নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও বন্দী পলায়ন রোধে ব্যর্থতার জন্য দায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কারাবিধি ও চাকরিবিধি অনুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সব কারাগারে নিজ কারা ভবনের বাইরে কয়েদিদের নির্ধারিত পোশাক পরা নিশ্চিত করতে হবে। বন্দীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও পূর্ব অপরাধের ভিত্তিতে বিশেষ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। কারাগারে যে কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা সংঘটিত হলে তা দ্রুত অবহিতকরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে কারা অধিদফতরের চিঠি প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘আমরা বন্দী ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপত্তার বিষয়টি নতুন করে সাজিয়েছি। বিশেষ করে সিসিটিভির বিষয়টি কঠোরভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। এ জন্য সুনির্দিষ্টভাবে দায়িত্ব বণ্টন করা হয়েছে। তবে কভিড নিয়ে আগের মতোই সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।’

সর্বশেষ খবর