শুক্রবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বাড়িতে চিকিৎসা ৯৬ শতাংশ রোগীর

মাত্র ৪ শতাংশ করোনা হাসপাতালে ভর্তি

জয়শ্রী ভাদুড়ী

দেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের ৯৬ শতাংশ বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন মাত্র ৪ শতাংশ রোগী। বাড়িতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাচ্ছেন অনেক করোনা পজিটিভ রোগী। হাসপাতালে ৭৩ শতাংশ শয্যা ফাঁকা থাকলেও ভোগান্তির ভয়ে হাসপাতালমুখী হচ্ছেন না রোগীরা।

করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার শুরু থেকেই হাসপাতালে সেবার মান নিয়ে নানা অভিযোগ, অব্যবস্থাপনা দেখা গেছে। এতে কভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য খুব গুরুতর না হলে কেউ হাসপাতালে যেতে চাইছেন না। অনেক ক্ষেত্রে করোনা আক্রান্ত রোগীদের সামাজিকভাবেও হেনস্তা হতে হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘মৃদু ও উপসর্গহীন রোগীদের এমনিতেই হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তবে শ্বাসকষ্ট বেশি হলে কিংবা অন্যান্য সমস্যা তীব্র হলে অবশ্যই হাসপাতালে যেতে হবে।’ স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গতকাল করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ২ হাজার ১৫৮ জন। এ পর্যন্ত করোনা শনাক্ত হয়েছেন ৩ লাখ ১৯ হাজার ৬৮৬ জন, সুস্থ হয়েছেন ২ লাখ ১৩ হাজার ৯৮০ জন। গতকাল করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩২ জন, এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৪ হাজার ৩৮৩ জন। বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১ লাখ ১ হাজার ৩২৩ জন। এর মধ্যে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৪ হাজার ১১৪ জন, যা মোট রোগীর ৪ শতাংশ। বাড়িতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৯৬ হাজার ৯৪০ জন, যা বর্তমানে চিকিৎসাধীন রোগীর ৯৬ শতাংশ। বিপুল পরিমাণ রোগী বাড়িতে চিকিৎসা নেওয়ায় শয্যা ফাঁকা থাকছে হাসপাতালে। সারা দেশের কভিড হাসপাতালে সাধারণ শয্যা রয়েছে ১৪ হাজার ৪৭৪টি, আইসিইউ শয্যা রয়েছে ৫৫০টি। এর মধ্যে সাধারণ শয্যায় রোগী ভর্তি রয়েছেন মাত্র ৩ হাজার ৭৯৮ জন এবং আইসিইউ শয্যায় রোগী ভর্তি রয়েছেন ৩১৬ জন। মোট ৭৩ শতাংশ শয্যা ফাঁকা রয়েছে। বাড়িতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোগী মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। গতকাল করোনা আক্রান্ত হয়ে ৩২ জন রোগী মারা গেছেন। এর মধ্যে একজন মারা গেছেন বাড়িতে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। করোনা রোগী ভর্তি না হওয়ায় কভিড হাসপাতালগুলোকে নন-কভিড ঘোষণা করা হচ্ছে। বুধবার হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে নন-কভিড করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। রোগী কমে যাওয়ায় ১২টি কভিড হাসপাতালকে নন-কভিড করার প্রস্তাব দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। সে প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে এ সিদ্ধান্ত জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। চীনে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হলে প্রস্তুতি হিসেবে ৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালকে কভিড-১৯ বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্ধারণ করে সরকার। ৮ মার্চ দেশে প্রথম কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। পরে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালসহ কয়েকটি সরকারি হাসপাতালকে কভিড বিশেষায়িত হাসপাতাল ঘোষণা করে সরকার। রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় কভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালকেও অনুমোদন দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর। অবহেলায় পড়ে থাকা মতিঝিলের রেলওয়ে হাসপাতালটি করোনার জন্য নির্ধারণ করার পর প্রায় দেড় মাস ধরে এটির সংস্কার করা হয়। ১ মে ৩০ শয্যার রেলওয়ে হাসপাতালে রোগী ভর্তি করা শুরু হয়। আইসিইউর সুবিধা না থাকায় জটিল রোগী এখানে রাখা হতো না। স্বাস্থ্য অধিদফতর বিজ্ঞপ্তির তথ্য অনুযায়ী, ১০ জুলাই থেকেই এই হাসপাতালে কোনো রোগী ভর্তি নেই। ১৫ আগস্ট থেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা ইউনিটে রোগী ভর্তি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। করোনা রোগী বাড়তে শুরু করলে চাপ বাড়তে থাকে হাসপাতালগুলোতে। প্রস্তুতিতে ঘাটতি থাকায় হাসপাতালে ভর্তি হতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হন রোগীরা। হাসপাতালের দরজায় রোগী মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। হাসপাতালে ভর্তি হলেও স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাচ্ছিলেন না তারা। হাসপাতালের টয়লেটে করোনা রোগী মৃত অবস্থায় পড়ে থাকলেও জানতেন না স্বাস্থ্যকর্মীরা। জ্বরের ঘোরে রোগী বিছানা থেকে পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে গেলেও কোনো স্বাস্থ্যকর্মী আসেননি রাতভর। এসব কারণে হাসপাতাল ভীতি তৈরি হতে থাকে রোগীদের মধ্যে। রাজধানীর রামপুরা এলাকার বাসিন্দা ফিরোজ আহমেদের পাঁচজনের পরিবারের সবাই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা। হাসপাতালে ভর্তি না হওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমার বড় ভাই করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি যেসব খারাপ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন তা শুনে আমরা হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার চিন্তাও করিনি। চিকিৎসকের পরামর্শে বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছি, নিয়মিত খাবার, ব্যায়াম, পড়াশোনার মধ্যে মন ও শরীরকে ব্যস্ত রাখছি। হালকা শ্বাসকষ্ট আছে তবে তা গুরুতর নয়। হাসপাতালের চেয়ে বরং পুরো পরিবার একসঙ্গে থাকলে আমাদের মনোবল অটুট থাকবে।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক ডেপুটি ডিরেক্টর ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুখলেসুজ্জামান হিরো বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনা রোগীরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আগ্রহ হারিয়েছেন। হাসপাতালের ভোগান্তি, অব্যবস্থাপনা রোগীদের মনে হাসপাতালবিমুখতা তৈরি করেছে। করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ার সময়ে চিকিৎসার জন্য মানুষ হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছে। করোনা টেস্ট, হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়রানি পোহাতে হয়েছে তাদের। বেসরকারি হাসপাতালে লাখ টাকার বিল, ভুতুড়ে বিল, টেস্ট নিয়ে প্রতারণার চিত্র উঠে এসেছে। এজন্য করোনা আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে বাড়িতে চিকিৎসা নেওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়েছে।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর