রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যানজটকবলিত গাজীপুর এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ২২ জেলার দ্রুত ও সহজ যোগাযোগের জন্য এগিয়ে চলছে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ। ২০২২ সালের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ঢাকা-গাজীপুরের সাড়ে ২০ কিলোমিটার পথে যাতায়াত করা যাবে সর্বোচ্চ আধা ঘণ্টায়। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে যাতায়াত অনেক স্বাচ্ছন্দ্যের হবে। গণপরিবহনে যোগ হবে নতুন মাত্রা। বদলে যাবে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যাতায়াতে নিত্য দুর্ভোগের চিত্র। বিআরটি রুটে বিদ্যমান মহাসড়কের ওপর দিয়ে পৃথক লেনে দুই দিক থেকে ১০০ আর্টিকুলেটেড (জোড়া) বাস প্রতি ঘণ্টায় ২৫ হাজার যাত্রী পরিবহন করবে। এর ফলে ঢাকা ও গাজীপুরের যাত্রী ছাড়াও উত্তরাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের দুর্ভোগ লাঘব হবে। এখন ঢাকা থেকে গাজীপুর যেতে কখনো কখনো তিন ঘণ্টারও বেশি সময় দুঃসহ যানজটে অপেক্ষা করতে হয়। বিআরটি এই পথের যাত্রীদের নিত্য যাতায়াতে স্বাচ্ছন্দ্য এনে দেবে। গত চার মাসে করোনার ধকল কাটিয়ে এখন পুরোদমে কাজ চলছে বিআরটি প্রকল্পের। বুধবার বিকালে প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রাজধানীর বিমান বন্দর মোড়, উত্তরা, হাউসবিল্ডিং, টঙ্গী ব্রিজ, চেরাগ আলী, বোর্ড বাজার, গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে প্রকল্পের কাজ চলছে। ভারী যন্ত্রপাতি নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারদের তত্ত্বাবধানে শত শত শ্রমিক কাজ করছে। নির্মাণযজ্ঞের কারণে ধুলায় ধূসরিত পুরো এলাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি), সেতু কর্তৃপক্ষ ও সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ)।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এই রুটে লাখ লাখ যাত্রী দ্রুত তাদের গন্তব্যে যেতে পারবে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানজট অনেকটাই কমে যাবে। যাতায়াতের সময় কমে যাওয়ার কারণে বাসের ট্রিপ সংখ্যা বেড়ে যাবে। ফলে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের আয় বাড়বে। যাত্রীরা দ্রুততম সময়ে কর্মস্থলে পৌঁছার ফলে কর্মদক্ষতা বেড়ে যাবে, যার প্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতিতে।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, সাড়ে ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ঢাকা-গাজীপুর বিদ্যমান সড়কের মাঝ বরাবর নির্মিত হচ্ছে বাস র্যাপিড ট্রানজিটের রুট। প্রকল্পে থাকছে, চার দশমিক ৫ কিলোমিটার এলিভেটেড ফ্লাইওভার ও সেতু। যার মধ্যে ৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার ৬ লেন বিশিষ্ট এবং ১ কিলোমিটার ২ লেন বিশিষ্ট। থাকছে ৬টি এলিভেটেড স্টেশন ও ১০ লেন বিশিষ্ট টঙ্গী সেতু। ৬টি উড়াল সড়ক ও আন্ডারপাস। জলজট নিরসনে প্রকল্পের আওতায় টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ড্রেন নির্মাণের কাজ চলছে। ধীরগতির যানবাহন চলাচল করবে পৃথক লেনে। দ্রুতগতির যান চলাচলের জন্য সড়কের মাঝ বরাবর দুই লেন পৃথক করা হবে। ২০১২ সালে বিআরটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে নানা জটিলতায় প্রকল্পের কাজ বিলম্বিত হয়। শুরুতে প্রকল্পটি ২ হাজার ৪০ কোটি টাকার প্রাক্কলন করা হলেও ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় বাড়িয়ে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা করা হয়। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, বাস র্যাপিড ট্রানজিট-বিআরটি প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি এখন ৪২ ভাগ। করোনাকালে প্রকল্পের নির্মাণকাজ বন্ধ থাকলেও গত দেড় মাস ধরে কাজ চলছে। সম্প্রতি কাজে আরও গতি এসেছে। এদিকে টঙ্গী-জয়দেবপুর সড়কে জনদুর্ভোগ কমাতে প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিতে নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, কোনো কারণেই কাজ থেমে থাকবে না। এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। প্রকল্পের অর্থ সংকট এখন কেটে গেছে। তাই বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো রকম জটিলতা নেই।
সরকারের তিন প্রতিষ্ঠান প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। তবে বিভিন্ন কারণেই সবার অগ্রগতি এক রকম নয়। বিআরটি, গাজীপুর-বিমানবন্দরের সেতু কর্তৃপক্ষ অংশের প্রকল্প পরিচালক লিয়াকত আলী বলেন, ‘বিআরটি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে এলজিইডি, সেতু কর্তৃপক্ষ এবং সওজ মিলে। আমাদের সেতু কর্তৃপক্ষ অংশের অগ্রগতি ৩২ শতাংশ। তিনি বলেন, করোনা সংক্রমণ, বন্যা, বর্ষার কারণেও কাজ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এখন কাজের গতি ফিরেছে। আশা করছি, সব সমস্যা কেটে যাবে। সেতু কর্তৃপক্ষের অংশের কাজ পিছিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘স্মেক’ লিখিতভাবে জানিয়েছে, ভূগর্ভস্থ এবং মাটির ওপরে অবস্থিত বিভিন্ন ধরনের ইউটিলিটি লাইন থাকায় অনেক স্থানেই পাইল ক্যাপ রি-ডিজাইন করতে হচ্ছে। হাউসবিল্ডিং থেকে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত আর কোনো পাইল অবশিষ্ট না থাকায় টঙ্গী ব্রিজ থেকে চেরাগ আলী পর্যন্ত অবশিষ্ট ১৬০টির মতো পাইল নির্মাণ করতে হবে। এ দূরত্ব পর্যন্ত ভূগর্ভস্থ ইউটিলিটি থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব ও ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের অন্যতম বাস অপারেটর এনা ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, যানজটের কারণে মহাখালী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত যেতে যত সময় লাগে এর চেয়ে অনেক কম সময়ে ময়মনসিংহ পৌঁছানো যায়। এই রুটে বছরের পর বছর যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত ফোর লেন প্রকল্প চালু হলেও ঢাকা-গাজীপুরের দুর্ভোগের কারণে এর সুবিধা যাত্রী ও পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, বিআরটি প্রকল্পের কাজ শেষ হলে আশা করি জনদুর্ভোগ কমবে। সেইসঙ্গে যাত্রীদের চলাচলের পথ আরও সুগম হবে। তিনি দ্রুত প্রকল্পের কাজ শেষ করার তাগিদ দেন। গত সপ্তাহে বিআরটি প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় অংশ নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেন, কাজ থেমে নেই। সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৪২ ভাগ। প্রকল্প এগিয়ে নিতে এখন আর কোনো জটিলতা নেই। আশা করছি, দ্রুত কাজ শেষ হবে। কাজের গতি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে মন্ত্রী বলেন, সরকার একে একে সবটুকু উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ করতে চায়। সংকট যতই আসুক উন্নয়ন থেমে থাকবে না। যে কোনো মূল্যে আমরা সম্ভাবনার সব প্রকল্পের কাজ শেষ করব। প্রকল্পের ১ নম্বর প্যাকেজের আওতায় ১৬ কিলোমিটার বিআরটি লেন ও ১৯টি স্টেশনসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনা নির্মাণের কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীনা গেঝুবা গ্রুপ করপোরেশন (সিজিজিসি)। গত জুন পর্যন্ত প্যাকেজটির নির্মাণকাজ এগিয়েছে ৪২ দশমিক ৫২ শতাংশ। বৈঠকে এ প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়। পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. এস এম সালেহ উদ্দিন বলেন, বিআরটি প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে শুধু গাজীপুর-জয়দেবপুরের যাত্রী নয়, উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলের যাত্রী ও পরিবহন সেবায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে। রাজধানীর প্রবেশ পথের যানজট সমস্যার সমাধান হবে। নির্মাণকাজে সমন্বয় বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, কাজের সমন্বয় এবং পরিচালনাকালে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বটি ভালোভাবে পালন করতে হবে। ব্যবস্থাপনা ভালো হলে এর সুফল পাওয়া যাবে।
 
                         
                                     
                                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                         
                                        