সোমবার, ২২ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা
দিল্লির চিঠি

পশ্চিমবঙ্গের ভোটকে বিজেপি বানিয়ে দিচ্ছে দুই-দলীয় লড়াই

এম জে আকবর

পশ্চিমবঙ্গের ভোটকে বিজেপি বানিয়ে দিচ্ছে দুই-দলীয় লড়াই

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার আসন ২৯৪টি। এর মধ্যে শতাধিক আসন এলাকায় মুসলিম ভোটাররা ‘কে জিতবে’ তা নির্ধারণ করার মতো অবস্থায় রয়েছেন। এদের সংখ্যা উত্তর চব্বিশ পরগনা থেকে শুরু করে দিনাজপুর পর্যন্ত পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোয় দ্রুত বাড়ছে।

মুসলিমপ্রধান এলাকার ভোট আকর্ষণে দলগুলো স্থানীয় ফ্যাক্টরকে বিবেচনায় রেখে নানা প্রতিশ্রুতি দেয়। প্রতিটি নির্বাচনেই ওদের স্বপ্ন দেখানোর প্রতিযোগিতা চলে। তবে এ বছর যে ভোট আসন্ন  তাতে আগের দৃশ্য নাও দেখা যেতে পারে। কারণ ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) গেল ১০ বছরে সাংগঠনিক শক্তি এতটাই বাড়াতে পেরেছে যে, তাতে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন সরাসরি দুই-দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরিণত হতে চলেছে। মুসলমানদের সংখ্যা ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকবর্গের মাথাব্যথা তৈরি করত। ১৮৭১ সালের আদমশুমারিতে ধরা পড়েছিল যে, ‘বাংলা’ (যা দ্বিখন্ডিত হয়ে একদা পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ হয়েছিল এবং যাকে বলা হতো ‘ব্রিটিশ বেঙ্গল’) নামক ভূখন্ডে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাজনিত সুযোগ-সুবিধা তারা নিয়েছে। এদের অধিকাংশই হিন্দু জমিদারদের অধীনস্থ কৃষক। বিষয়টি ছিল অর্থনৈতিক সমস্যা; এর সমাধানও হওয়া উচিত অর্থনৈতিক। কিন্তু ব্রিটিশরা তা করল না। তারা চাতুরীর সঙ্গে সৃষ্টি করল ধর্মীয় স্ফুলিঙ্গ। বাংলার জনগণের মধ্যকার জাতীয়তাবোধকে স্তিমিত করার মতলবে তারা ধর্মীয় সত্তা জাহিরে প্ররোচিত করতে থাকে। তাতে অবশ্য ভারতের স্বাধীনতা রুখে দেওয়া যায়নি কিন্তু পয়দা করা গিয়েছিল দেশ-ভাগ। ইতিহাস বলছে, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দেশভাগ প্রকল্পে যোগ দিতে বাংলা যদি নারাজ হতো তাহলে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি কখনই সম্ভব হতো না। ওই শুমারিতে দেখা যায়, বাংলার (তখন উড়িষ্যার বিরাট একটি অংশ এবং বিহারের কিছু জায়গা এই প্রদেশভুক্ত ছিল) ৪৩ জেলার জনসংখ্যা ৬ কোটি ৪৬ লাখ ৭ হাজার ৭২৪। কলকাতার নাগরিক ৭ লাখ ৯৫ হাজার, কেবলমাত্র লন্ডন নগরীর লোকসংখ্যাই এই সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। শাসকদের যে ব্যাপারটি চমকে দিয়েছিল সেটা হলো বেশ কয়েকটি জেলার ধর্মীয় মিশ্রণ- হিন্দু আর মুসলমানদের মিলেমিশে বসবাস। জেলাগুলো ছিল : ঢাকা, ফরিদপুর, রংপুর, পাবনা, রাজশাহী, ত্রিপুরা, বর্ধমান, যশোর, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, মেদেনীপুর, হুগলি ও চব্বিশ পরগনা। এসব বাস্তবতার বিবরণ সংবলিত একটি ‘স্মারক’ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পেশ করা হয়েছিল। স্মারকে বলা হয়- ‘বাংলা ও আসামে মোট মুসলমান ২ কোটি ৫ লাখ। এর মধ্যে পূর্ববঙ্গ এবং তার সংলগ্ন সিলেট কাছাড় জেলায় ১ কোটি ৭৫ লাখ মুসলমানের বাস। এই জেলাগুলোর বিরাট সংখ্যক মানুষের পেশা কৃষি ও শ্রমদান। অন্যদিকে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার মানুষের জীবিকা সমুদ্রনির্ভর। এর কারণ সম্ভবত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হয়ে ওই দুই জেলায় গিয়ে থিতু হয়েছে।’

মুসলমানদের মধ্যে যারা অভিজাত শ্রেণিভুক্ত তাদের সংখ্যা ১৩ শতাংশ মাত্র। উড়িষ্যায় হিন্দুর বিপুল সংখ্যাধিক্য। ফলত উড়িষ্যা ও বিহারের রাজনীতি ভিন্নতর গতিমুখ ধরে চলছে। বাংলা নিয়ে ব্রিটিশদের মতলববাজি নিহিত ছিল, ‘কৃষিজীবী ও শ্রমিক শ্রেণির বিরাটাংশকে কেন্দ্র করে। এই লোকগুলোর দুঃখ-কষ্টের জন্য দায়ী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রবর্তিত জমির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা। কিন্তু শাসকরা বোঝায়, ‘মুসলমানরা ক্ষমতা হারিয়েছে বলেই তাদের যত দুর্গতি।’ হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের ক্ষোভকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানিয়ে তা বিদেশি প্রভুর স্বার্থসেবায় লাগানোর জন্যই এমন প্রচারণা চালানো হয়েছিল।

তারা ১৯০৫ সালে দুই-তৃতীয়াংশ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় নতুন প্রদেশ ‘পূর্ববঙ্গ’ গঠন করে। পাশাপাশি গঠন করে হিন্দু জনআধিক্য এলাকা নিয়ে ‘পশ্চিমবঙ্গ’। জনসংখ্যা অনুপাতে ক্ষমতা বণ্টন করে। নিবেদিতপ্রাণ সাম্রাজ্যবাদী লর্ড নাথানিয়াল কার্জন (যিনি ভাইসরয় ছিলেন ১৮৯৯ থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত) ঘটনাটি ঘটানোর পর পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ক্রমশ বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে উঠেছিল। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর ঢাকা হয়ে গেল পূর্ববঙ্গ প্রদেশের রাজধানী। লেফটেন্যান্ট-গভর্নর হয়ে এলেন ঘোরতর সাম্রাজ্যবাদী আইসিএস অফিসার স্যার বামফিল্ড ফুলার। বাংলাকে বিকৃত করে নতুন প্রদেশ করায় ক্ষুব্ধ হিন্দুরা লে-গভর্নর ফুলারকে স্বাগত জানায়নি। মুসলিম নেতাদেরও অনেকের মতে, ‘সমস্যার প্রতিকার নয়, নতুন প্রদেশ নতুন এক সমস্যা।’ তবে এমন আওয়াজও দেওয়া হয়েছিল যে, বাঙালি মুসলমানদের দৈহিক ও আর্থিক নিরাপত্তা বিধান করবে ব্রিটিশ শক্তি। ফুলার ওয়াদা করলেন যে, বাঙালি মুসলমানদের জন্য মুঘল আমলের সুযোগ-সুবিধা চালু করবেন। তার এই ঔপনিবেশিক চাতুরীজনিত বুলি হাওয়ায় আগুন ধরিয়ে দেয়। ১৯০৬ সালে ফুলার পদত্যাগ করলে বঙ্গভঙ্গের সমর্থক মুসলিম সংগঠনগুলো তার সমর্থনে জনসভা করেছে। ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ পত্রিকা বলেছে- ‘বঙ্গভঙ্গ হচ্ছে ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাসে মারাত্মক ভুলগুলোর অন্যতম।’ (এই ফুলার পরবর্তী জীবনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় গ্যাস আক্রমণের অ্যালার্ম উদ্ভাবক হিসেবে বিখ্যাত হন।) বঙ্গভঙ্গ রদ হয় ১৯১১ সালে। কিন্তু তার ক্ষত রয়ে যায় তিন দশকের বেশি সময়। ব্রিটিশ শাসনকালে সর্বশেষ যে নির্বাচন হয় ১৯৪৬ সালে তাতে বাংলার ১৯৯ আসনের মধ্যে ১১৩টি জিতে নেয় মুসলিম লীগ। কংগ্রেস পায় ৮৬ আসন। সরকার গঠন করে মুসলিম লীগ। এরপর কলকাতা ও বাংলা কলুষিত হলো সহিংসতা আর দাঙ্গায়। ঐক্যবদ্ধ বাংলার সব আশা চুরমার হয়ে গেল। ব্রিটিশ শাসনের চূড়ান্ত বছর ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট শুক্রবার শুরু হয় যে ভয়ংকর রক্তক্ষয় ইতিহাসে তা ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ নামে চিহ্নিত। তদানীন্তন মুসলিম সরকারের প্রশ্রয়ে দাঙ্গাবাজরা মানুষের রক্ত ঝরাতে শুরু করেছিল। কলকাতা নগরীর সেই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে পূর্বদিকে নোয়াখালীতে আর উত্তরদিকে বিহারে। রক্ত ঝরানোর জন্য উন্মত্ত শক্তিকে কে থামাবে? এগিয়ে এলেন মহাত্মা মোহনচাঁদ করমচাঁদ গান্ধী। স্থির করলেন, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দিল্লিতে অনুষ্ঠেয় ভারতের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে তিনি থাকবেন না। তার উপযুক্ত স্থান কলকাতা নগরী-বাংলার প্রাণকেন্দ্র। এখান থেকে তিনি শান্তির জন্য নিজেকে নিবেদন করবেন। তিনি মনে করেন, বাংলায় শান্তি নিশ্চিত করতে পারলে সর্বত্র হত্যা ও শরণার্থী গমনাগমনের ঢল বন্ধ হয়ে যাবে। জনাকীর্ণ বস্তির পরিত্যক্ত ঘরকে আস্তানা বানিয়ে মহাত্মা সেখান থেকে শান্তি আন্দোলন চালাতে থাকলেন। সব উদ্যোগ বিফলে গেল। বাকি রইল তার জীবন। শান্তির স্বার্থে ওটা উৎসর্গ করবেন তিনি। শুরু করলেন আমরণ অনশন। বললেন শান্তির সুবাতাস বইলেই শুধু অনশন ভাঙবেন। বাংলার জনগণ উতলা হলো। তাদের চোখে পানি। থেমে গেল হত্যা। ব্রিটিশ মালিকানাধীন সংবাদপত্র স্টেটসম্যান বলল- ‘এটা অলৌকিক!’ ভারতের সর্বশেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন চিঠিতে মহাত্মা গান্ধীকে বলেন, ‘আমার অধীনে হত্যা-দাঙ্গা রোধ করতে সক্ষম ৫০ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী রয়েছে পাঞ্জাবে। আর সারা বাংলায় ছিল একজন মানুষ এবং তিনি শান্তি আনলেন।’ গান্ধীর নৈতিক বিজয় বাংলার নৃতাত্ত্বিক পরিবেশের ওপর তাৎপর্যময় প্রভাব ফেলেছিল। এর দ্বারা রাজ্যটির ভবিষ্যৎ নির্বাচনী মানচিত্রও প্রভাবিত। বাংলার মতো পাঞ্জাবও ভাগ হয়েছে। তখন দেখা গেছে এই পাঞ্জাবের সব মানুষ ওই পাঞ্জাবে এবং ওই পাঞ্জাবের লোক এই পাঞ্জাবে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের বেলায় তেমন ঘটেনি, পূর্ববঙ্গ (আজকের বাংলাদেশ) সীমান্তের লাগোয়া জমিনেই তারা থেকে গেছে। এসব জেলায় গেল সাত দশকে পশ্চিমবঙ্গীয় মুসলিমদের জনঘনত্ব বিরাট আকার নিয়েছে। এ যেন পশ্চিমবঙ্গের ভিতরেই এখন একটি পূর্ববঙ্গ। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন প্রসঙ্গে ধারণগত চিত্র বলছে, তৃণমূল কংগ্রেস তার ভোটশক্তি সংহত করে চলেছে। পাল্লা দেওয়ার জন্য নিজেকে জোরদার করছে বিজেপি। বাম দলগুলোও সংঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে। এতে সুফল মিলবে? অঙ্ক সূত্রটা হতে পারে : নাথিং প্লাস নাথিং ইজ ইকুয়াল টু নাথিং! ভারতের গণতন্ত্র একাধিক ক্রান্তির ভিতর দিয়ে এগিয়েছে। একটা সময় চলেছে স্থিতাবস্থা; পরে চলেছে সন্দেহ। স্থান-বৈশিষ্ট্যের প্রভাবে নির্বাচনী ফলাফল কোনো কোনো সময় ঝাঁকুনি খেলেও সাধারণত এই ফলাফল সিদ্ধান্তদায়কই হয়ে থাকে। সেদিক থেকে ২০২১ সালের নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গের জন্য খুবই গুরুতর। অতীতের জারিজুরি বর্তমানের বিচক্ষণতা নাকি ভবিষ্যতের আকাক্সক্ষা- কোনটার দ্বারা চালিত হবে এই রাজ্য, তা জানতে ২ মে ভোটের ফল ঘোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করাটা চমৎকার অপেক্ষা বটে।

সর্বশেষ খবর