শনিবার, ২৬ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

অনলাইনে চলছে মাদকের কারবার

৪০টি পেজ-অ্যাপস চিহ্নিত, ডার্ক ওয়েব নিয়ে আতঙ্ক

সাখাওয়াত কাওসার

কোনোভাবেই যেন ঠেকানো যাচ্ছে না মাদকের আগ্রাসন। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এতদিন স্পটকেন্দ্রিক মাদকের কারবার হলেও বর্তমানে তা চলছে অনলাইনে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ৪০টির মতো বিভিন্ন পেজ, গ্রুপ এবং অ্যাপস ব্যবহার করে রীতিমতো হাট বসছে মাদকের। অনলাইনে মাদকের অর্ডার করলে মুহূর্তেই তা পৌঁছে যাচ্ছে ক্রেতার দোরগোড়ায়। তবে আতঙ্কের বিষয় হলো, এতে করে মাদকের ক্রেতা এবং বিক্রেতারা থেকে যাচ্ছে নজরদারির বাইরে। সম্প্রতি নতুন মাদক ‘এলএসডি’ (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইইথালামাইড) এবং ‘ব্রাউনি কেক’ উদ্ধারের পর অনলাইন কেন্দ্রিক মাদক ব্যবসার বিষয়টি ভাবিয়ে তুলছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমেও  বেচাকেনা হচ্ছে মাদক। যদিও তারা বলছেন, কেউই নজরদারির বাইরে নন। তবে রীতিমতো অসহায়বোধ করছেন মাদক নিয়ন্ত্রণের বিশেষ সংস্থা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি)। কারণ বিশেষায়িত এই সংস্থাটির সাইবার নজরদারির কোনো ইউনিট নেই। প্রযুক্তিগত সুবিধা না থাকায় ডিজিটাল বাংলাদেশের এই সময়ে তারা এখনো সেই অ্যানালগ যুগে।

ডিএনসির মহাপরিচালক (ডিজি) মোহাম্মদ আহসানুল জব্বার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী মাদক নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছি। অনেক সমস্যা রয়েছে। তবে সেগুলো পর্যায়ক্রমে সমাধানের চেষ্টা হচ্ছে। আগে রেশন ছিল না, যানবাহনের সমস্যা প্রকট ছিল এখন সেগুলোর সমাধান করা হয়েছে। সাইবার কিংবা প্রযুক্তির সন্নিবেশনের বিষয়ে কথা বলা হবে। দেখুন, এলএসডিও কিন্তু দেশে আমরা প্রথম ধরেছি। ধানমন্ডিতে আইসের ল্যাবরেটরি উদ্ঘাটন, ঢাকা ও কক্সবাজারে অভিযান চালিয়ে আইসের চালান ধরেছি। এলিট ফোর্স র‌্যাবের গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল খায়রুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অনলাইনে মাদকের বেচাকেনা অনেকগুণ বেড়েছে। তবে এর সঙ্গে জড়িত অনেককে আমরা এরই মধ্যে গ্রেফতারও করেছি। তবে আমাদের নজরদারির বাইরে কেউ নয়। মাদক নির্মূল র‌্যাবের অন্যতম একটা ম্যান্ডেট। ‘চল যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ এমন স্লোগান দিয়ে র‌্যাবই বিশেষ অভিযান শুরু করেছিল। 

অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, ইনস্ট্রাগ্রাম, মেসেঞ্জার, রেড্ডিট, আইসিকিউ, ফেসবুক গ্রুপ তৈরি করে রাজধানীর অভিজাত এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলছে মাদকের ধুন্দুমার কারবার। ‘বেটার ব্রাওরি অ্যান্ড বেয়ন্ড’ ও ‘আপনার আব্বা’, দ্য ব্রাউনি গাই, উইইড বিডি, উইইড লাভার ৭, ইয়াবা বিডি, আমরা শান্তি চাই, রঙ্গিন দুনিয়া, ওম শান্তি, জাস্ট এনজয়, এসো মজা করি, ইয়াবা স্টোর বিডিসহ বিভিন্ন ফেসবুক পেজ, গ্রুপ ও আইডির সন্ধান পেয়েছে আইন প্রয়োগকারূী সংস্থার সদস্যরা। পরিচিত এবং নিয়মিত কাস্টমারদের এসব গ্রুপে যুক্ত করেন অ্যাডমিন। গত বছরের মে মাসে ‘উইইড লাভারস’ নামে ১৫ হাজার সদস্যের একটি ফেসবুক গ্রুপ চিহ্নিত করে দুজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এই গ্রুপে প্রকাশ্যে গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য সেবন ও বিক্রির প্রচার চালানো হচ্ছিল। ‘বেটার ব্রাওরি অ্যান্ড বেয়ন্ড’, দ্য ব্রাউনি গাই পেজের ফলোয়ার সাত হাজারের বেশি। বিভিন্ন অনলাইনে ইয়াবা পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা থেকে ২২০ টাকা। খুচরা বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। তবে খুচরা তিন থেকে পাঁচ পিস হোম ডেলিভারি দেওয়া হয়। বর্তমানে সবচেয়ে কাক্সিক্ষত মাদক ‘আইস’ (ক্রিস্টাল মেথ) পাওয়া যাচ্ছে প্রতি এক গ্রাম ৭ থেকে ৮ হাজার টাকায়। যদিও কিছুদিন আগ পর্যন্ত এক গ্রাম আইসের দাম ছিল ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা। ডিএনসির একজন কর্মকর্তা বলেন, ইয়াবার চেয়ে ১০০ গুণ বেশি ক্রেজি ড্রাগস হলো আইস। বর্তমানে এর চাহিদা আকাশচুম্বী।

অনলাইনে ফেনসিডিলের দাম পড়ছে ১৭০০ থেকে ২০০০ টাকা। তবে হোম ডেলিভারির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ তিন পিসের বেশি দেওয়া হচ্ছে না। নিরাপত্তার বিবেচনায় শর্ত অনুযায়ী গ্রুপগুলোর সদস্য হতে হলে কমপক্ষে আরও দুই থেকে তিনজনের সুপারিশ লাগে। তাও বিশ্বস্ততার জন্য নতুন সদস্যকে অন্তত এক মাস অপেক্ষা করতে হয় বিশ্বস্ততার জন্য। পরবর্তীতে অনলাইনে মাদক বিক্রির পেজে কমেন্ট কিংবা লাইক করলে বিক্রেতারা ইনবক্সে এসএমএস দেয়। এরপর চাহিদার পরিমাণের ওপর দাম নির্ধারণ করে। টাকা পরিশোধ করতে হয় বিকাশ, নগদ, রকেটের মতো বিভিন্ন মানি ট্রান্সফার এজেন্সির মাধ্যমে। পরে দাম ঠিকঠাক হলে তারা মাদক নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেন। এ ক্ষেত্রেও ক্রেতা এবং ক্যারিয়ারকে (মাধ্যম) চিনতে সাংকেতিক শব্দ ব্যবহার করছেন। তবে মাঝেমধ্যেই এসব ডেলিভারি বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে। অনলাইন প্লাটফরমগুলোতে ইয়াবার নাম ব্যবহার হয় আপেল/ইন্ডিয়ান আপেল/খাবার, ফেনসিডিল- জুস/মধু/ছক্কা, আইস-অ্যাসিড হিসেবে। 

গত বছরের ৮ জুন ফেসবুকে পেজ খুলে মাদকদ্রব্য ও নিষিদ্ধ যৌন উপকরণ বিক্রির অভিযোগে তিনজনকে গ্রেফতার করে অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ)। গুলশান-২ থেকে গ্রেফতারকৃতরা হলেন হেলালউদ্দিন, আলতাফ মৃধা ও ফাহিম। তাদের কাছ থেকে ১ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা, দুটি মুঠোফোন, ৫ হাজার ৪০টি ইয়াবা, প্রায় ৫ কেজি বিভিন্ন ধরনের নিষিদ্ধ যৌন উত্তেজক জেল এবং ১৬ ধরনের ব্যবহার নিষিদ্ধ অ্যাডাল্ট মালামাল উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতার ফাহমি ফেসবুকে ‘অনলাইন সার্ভিস’ নামে একটি পেজ খুলে মাদকদ্রব্য ও ব্যবহার নিষিদ্ধ যৌন উপকরণ বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি করতেন। তার কাছ থেকে মাদকের অর্ডার দিলে হোম ডেলিভারি দেওয়া হতো। এর কিছুদিন আগে হাজারীবাগের রায়েরবাজার এলাকায় গাঁজার হোম ডেলিভারি দেওয়ার সময় দুজনকে হাতেনাতে গ্রেফতার করে হাজারীবাগ থানা পুলিশ। তাদের কাছ থেকে গাঁজা কাটার মেশিনও পাওয়া যায়। একই এলাকা মাদকের হোম ডেলিভারি দেওয়ার সময় ইয়াবাসহ কয়েকজন মাদক বহনকারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গোয়েন্দারা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার বিভাগের শিক্ষার্থী হাফিজের মৃত্যুকে ঘিরে তদন্তে নতুন করে বেরিয়ে এসেছে এলএসডির বিষয়টি। উঠে এসেছে করোনাকালে অনেক শিক্ষার্থীর মাদক কারবারে নতুন করে ঝুঁকে পড়ার বিষয়টি। হাফিজ এলএসডি সংগ্রহ করতেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর ছাত্র সাদমান সাকিব রুপল ও আসহাব ওয়াদুদ তূর্য এবং ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র আদিন আশরাফদের ‘আপনার আব্বা’ নামে ফেসবুক গ্রুপ থেকে। এ ছাড়াও রুপল গ্রুপ নামে আরেকটি মাদক কেনাবেচার গ্রুপ রয়েছে। মাদক কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশে বসবাসরত আফ্রিকান বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা। ২০১৯ সালের ২৭ জুন ভাটারা থেকে আজাহ আনাইওচুকোয়া ওনিয়েনসি নামে এক নাইজেরিয়ানকে ৫২২ গ্রাম আইসসহ গ্রেফতার করে ডিএনসি। তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদে ওনিয়েনসি জানান, পার্সেলের মাধ্যমে উগান্ডা থেকে চালান এনে বিক্রির চেষ্টা করতেন। তারা আরও বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়াও ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমেও মাদকের কেনাবেচা হচ্ছে এমন খবর তারা পাচ্ছেন। ডার্ক ওয়েবে মাদক বিক্রি খুবই অ্যালার্মিং। এখানে হেরোইন, কোকেন ও আফিমের মতো মাদক বিক্রি হয়। বারিধারার একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন কয়েকজন রোগী জানিয়েছেন, তারা ইয়াবার পর আইস সেবন শুরু করেছেন। ধনী পরিবারের বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণরা ডার্কনেট অর্ডার করে পার্সেলে এবং পরিচিতজনের মাধ্যমে আইএসডি পেয়েছেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (গুলশান) মশিউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রযুক্তি এতটা দ্বারপ্রান্তে চলে আসছে, অনেক ভালো কাজের পাশাপাশি নিকৃষ্টতম কাজও অহরহ হচ্ছে। অনলাইন প্লাটফরমে জঙ্গিবাদ, সেক্স, মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের কাছে তারা ধরাও পড়ছেন। তবে বিষয়টি উদ্বেগের। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম এভাবে নিজের, পরিবারের এবং সর্বোপরি দেশের ক্ষতি করছেন। দেশে-বিদেশে পড়াশোনা করা অনেক তরুণ নিজের মেধাকে অপব্যবহার করছেন কেবল বাহাদুরী দেখানো এবং বাহবা পাওয়ার জন্য। তবে একটা বিষয় তাদের মাথায় রাখতে হবে তারা যে পথেই যাক না কেন আমাদের নজরদারির বাইরে তারা নন। আমরা নিয়মিতভাবেই তাদের আইনের কাছে সোপর্দ করছি। ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর