আফগানিস্তানে তালেবানের সরকার গঠন পিছিয়েছে। গতকাল পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রিসভা ঘোষণার কথা থাকলেও তা পেছানো হয়েছে। তালেবান বলেছে, আজ মন্ত্রিসভা ঘোষণা করা হতে পারে। তালেবানসূত্রের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছিল, গতকাল জুমার নামাজের পর নতুন সরকারের পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রিসভার ঘোষণা আসছে। তবে পরে তালেবানের একজন মুখপাত্রের বরাত দিয়ে বিবিসি ও এএফপি জানায়, সবচেয়ে দ্রুততম সময়ে হলেও শনিবারের (আজ) আগে নতুন সরকারের ঘোষণা করা হবে না। অবশ্য আগেই চারজন মন্ত্রীর নাম ঘোষণা করেছে তালেবান।
অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন গুল আগা। এ ছাড়া ভারপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সদর ইবরাহিম, ভারপ্রাপ্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোল্লা আবদুল কাইয়ুম জাকির ও ভারপ্রাপ্ত উচ্চশিক্ষামন্ত্রী হিসেবে আবদুল বাকি হাক্কানির নাম ঘোষণা করা হয়েছে।
এদিকে উত্তরের পাঞ্জশিরে তালেবানবিরোধী উত্তরাঞ্চলীয় জোটের সঙ্গে তালেবানের তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়েছে। উভয় পক্ষে আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার পর এ যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে বহু তালেবান যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। বিবিসি, রয়টার্স, সিএনএন, আলজাজিরা, পার্সটুডে।
প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, গতকাল জুমার নামাজের পর তালেবান সরকার ঘোষণার জন্য সব রকম প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। সরকারের রূপরেখা বা এতে কারা কারা থাকছেন তার তালিকাও করা হয়েছিল। এ তালিকা অনুযায়ী সরকারপ্রধান বা প্রধানমন্ত্রী হবেন তালেবানের সহপ্রতিষ্ঠাতা আবদুল গনি বারাদার এবং ইরানি ব্যবস্থার মতো সর্বোচ্চ নেতা হবেন তালেবানপ্রধান হায়বাতুল্লাহ আখুন্দজাদা। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে থাকবেন তালেবানের আরেক সহপ্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের ছেলে মোল্লা মোহাম্মদ ইয়াকুব ও শের মোহাম্মদ আব্বাস স্তানিকজাই।
সবকিছু ঠিক থাকলেও শেষ পর্যন্ত জুমার নামাজের পর নতুন সরকারের ঘোষণা দিতে পারেননি তালেবান নেতারা। সবাই ঘোষণা শোনার অপেক্ষায় থাকলেও সন্ধ্যারাত পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী সরকারের ঘোষণা দেওয়া হয়নি। জানা গেছে, গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব ও নানা মতপার্থক্যে সরকার ঘোষণা বিলম্বিত হচ্ছে।
পাঞ্জশিরে তীব্র লড়াই : ১৫ আগস্ট তালেবান কাবুল নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর ৫০ মাইল উত্তরের এ পার্বত্য এলাকায় এনআরএফ গড়ে তোলা হয়। স্থানীয় নেতা আহমদ মাসুদের নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়াদের সঙ্গে আফগান সামরিক বাহিনীর কমান্ডারদের একাংশ মিলে এ ফ্রন্ট গঠন করা হয়েছে। এনআরএফের মুখপাত্র আলী মাইসাম নাজারি গতকাল এএফপিকে বলেছেন, সারা রাত তালেবান বাহিনীর সঙ্গে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের লড়াই হয়েছে। আহমদ মাসুদ এ উপত্যকা রক্ষায় ব্যস্ত আছেন। ৩২ বছর বয়সী মাসুদ হলেন পাঞ্জশিরের প্রয়াত গেরিলা কমান্ডার আহমদ শাহ মাসুদের ছেলে। সোভিয়েত ও তালেবান বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে ‘পাঞ্জশিরের সিংহ’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন আহমদ শাহ মাসুদ। তালেবান এবার ক্ষমতা দখলের পর দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা আলোচনা হয়েছিল। তবে সেখানে সমাধান আসেনি জানিয়ে বুধবার মাসুদ এক বিবৃতিতে বলেন, তালেবান নতুন প্রশাসনে তাদের ‘এক বা দুটি’ পদ দিতে চেয়েছে। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। যুদ্ধে বহু হতাহতের খবর পাওয়া গেছে। তালেবান প্রদেশটির বেশ কিছু অঞ্চল দখলের দাবি করলেও তার কোনো নিশ্চিত সমর্থন পাওয়া যায়নি। বরং তালেবানবিরোধী উত্তরাঞ্চলীয় জোট বা ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্টের (এনআরএফ) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যুদ্ধে তালেবান পিছু হটে চলেছে। এদিন তালেবানের শতাধিক সদস্যও নিহত হয়েছে। এ ছাড়া জোট বাহিনী অর্ধশতাধিক তালেবান যোদ্ধাকে আটকও করেছে।
গৃহযুদ্ধ থামছে না : পর্যবেক্ষকদের মতে, আফগানিস্তানে ১৩-১৪টি জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। যার মধ্যে পাশতুন, তাজিক, হাজারা, উজবেক, তুর্কমেনি ও বালুচিসহ এমন অন্তত ৬-৭টি জাতিগোষ্ঠী রয়েছে, যারা সব সময়ই থেকেছে আফগান রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। পাশতুনরাই আফগানিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তারা মোট জনসংখ্যার (প্রায় ৪ কোটি) ৪২ শতাংশ। কিন্তু সেই পাশতুনরাও যে সার্বিকভাবে এক থেকেছে- তা নয়। যাকে হটিয়ে তালেবানরা এবার কাবুলের ক্ষমতা দখল করেছে, সেই পূর্বতন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি ও তার পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইও পাশতুন জাতিগোষ্ঠীরই নেতা। সুন্নি হলেও মূলত দক্ষিণ ও পূর্ব আফগানিস্তানে প্রভাব খুব বেশি থাকা পাশতুনদের পুরোপুরি পাশে পাওয়ার আশা করে না তালেবানরা। কারণ গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের মতো জনাকয়েক পাশতুন যুদ্ধপতি। যারা তালেবানদের কাছে মাথা নুইয়ে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ক্ষুণœ হতে দিতে রাজি নয়।
একইভাবে এর পরই রয়েছে তাজিক ও হাজারা জাতিগোষ্ঠী। আফগান মুল্লুকের মোট জনসংখ্যার ২৬-২৭ শতাংশ তাজিক আর ১০ শতাংশ হাজারা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। এই দুই জাতিগোষ্ঠীই কখনো তালেবানদের কাছে মাথা নত করেনি। পানশির উপত্যকাসহ গোটা উত্তর আফগানিস্তান, বাদাকশান ও পশ্চিম দিকের একটি বড় অংশ রয়েছে তাজিকদের নিয়ন্ত্রণে। এরাই তালেবানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য নয়ের দশকে নর্দার্ন অ্যালায়েন্স বা উত্তরের জোট গড়ে তোলে। ১৯৯৬ সালে তাজিক নেতা প্রেসিডেন্ট বুরহানউদ্দিন রব্বানিকে সরিয়ে প্রথম ক্ষমতায় এসেছিল তালেবানরা। এখন আহমেদ মাসুদের মতো তাজিক নেতাও তালেবানদের সবচেয়ে বড় শত্রু।
আর হাজারা জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ওপর আগের জমানায় নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিল তালেবানরা। শিয়া সম্প্রদায়ের হাজারাদের স্কুল, বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। মধ্য আফগানিস্তানে গৌতম বুদ্ধের মূর্তিসহ হাজারাদের অনেক স্থাপত্য নষ্ট করা হয়েছিল। উজবেকিস্তান সীমান্তে উত্তর আফগানিস্তানে থাকা উজবেক জাতিগোষ্ঠীও মানে না তালেবানদের। তারা মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ হলেও তালেবানদের বিরুদ্ধে বরাবরই গড়ে তুলেছে প্রতিরোধ। তাদেরই অন্যতম যুদ্ধপতি আবদুল রশিদ দস্তম। তুর্কমেনিস্তান সীমান্তে থাকা আফগানিন্তানের তুর্কমেনিরাও কখনো তালেবানদের আধিপত্য মানতে চায়নি। তারা উত্তরের জোটের বড় শক্তি হয়ে থেকেছে বরাবরই। আর পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশ লাগোয়া আফগানিস্তানের বালুচিরা কখনো তালেবানদের বরদাশত করেনি। তাই তারাও রয়েছে নর্দার্ন অ্যালায়েন্সেরই।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, আফগাস্তিানের সব জাতিগোষ্ঠীর হাতেই রয়েছে বিপুল অত্যাধুনিক সামরিক সাজ-সরঞ্জাম। ফলে দেশটিতে সহসাই গৃহযুদ্ধ দূর হবে- এটা আশা করার সময় আসেনি।