রবিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

মাদক মামলায় ভুয়া সাক্ষী

মাহবুব মমতাজী

মাদক মামলায় ভুয়া সাক্ষী

মাদক মামলায় বেশির ভাগ সাক্ষী ভুয়া! এরা কেউ জানেন না কোন ঘটনায়, কীসের সাক্ষী তারা। এদের কেউ কেউ একই থানার একাধিক মামলার সাক্ষী হয়েছেন। সাক্ষীর তালিকায় রাখা হয়েছে পথচারী, পুলিশের সোর্স, অটো, সিএনজি ও রিকশা চালকদের, যাদের বেশির ভাগের ঠিকানা ঠিক নেই। সাক্ষীদের মধ্যে আবার পুলিশ সদস্যও আছেন। তাদের যে ঘটনায় সাক্ষী বানানো হয়েছে সেসব ঘটনা সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না, যে কারণে থেমে থাকছে মাদক মামলার বিচার। রাজধানীর বিভিন্ন থানায় করা অন্তত ১০টির বেশি মামলার তথ্য অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা করে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তবে পুলিশ কর্মকর্তাদের কেউই এমন অনিয়মের কথা স্বীকার করেননি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভুয়া সাক্ষীতে মামলা হলে বিচার হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আসামি দোষী হলেও ছাড়া পেয়ে যেতে পারেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে নিরপরাধ ব্যক্তিও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এমন মামলায় আদালতে মামলাজটের পাশাপাশি সময় ক্ষেপণ, পুলিশের শ্রম সবই বৃথা যাচ্ছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ভুয়া সাক্ষীর বিষয়ে কে সত্য বলছেন তা নির্ধারণ করার বিষয়। আর যদি কেউ সাক্ষ্য না দেন তাহলে পুলিশ নাম-ঠিকানা কীভাবে পায়? সাক্ষী হয় বলেই নাম-ঠিকানা পায়।’

তথ্যানুসন্ধানে যা জানা গেছে : ২৯ জুন রাজধানীর ডেমরা থানায় হেরোইনের ৫১০ পুরিয়া জব্দের ঘটনায় একটি মামলা হয়। নম্বর ৪৭/৩০১। আসামি করা হয় কামাল হোসেন নামে একজনকে। মামলার বাদী ও জব্দ তালিকা প্রস্তুতকারী ছিলেন এসআই নাজনীন আক্তার। সাক্ষী করা হয় রাকিব হোসেন নামে এক সিএনজিচালক এবং রনি নামে এক অটোচালককে। এ ছাড়া ছানোয়ার হোসেন নামে আরেকজনকে সাক্ষী করা হয়। তিনি নিজেকে পুলিশ কনস্টেবল হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। রাকিবের ঠিকানা দেওয়া হয় ডেমরার গলাকাটা ব্রিজের ঢাল আর রনির ঠিকানা সারুলিয়া ওয়াসা রোড। এসব ঠিকানায় ওই দুই নামে কাউকে পাওয়া যায়নি। তাদের ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরও বন্ধ পাওয়া যায়। তবে ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম কি ছিলাম না তা আদালতে নথি দেখে আপনি জেনে নিন।’ জানতে চাইলে এসআই নাজনীন আক্তার এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আপনি সাক্ষীদের বিষয়ে এত সব জানতে চান কেন? সাক্ষী ভুয়া না মামলা ভুয়া তা আদালত দেখবে। আপনি দেখবেন আসামির ব্যাকগ্রাউন্ড কী। ফৌজদারি কার্যবিধিতে যা-ই থাকুক তা আমার দেখার বিষয় নয়।’ আসামি কামালের স্ত্রী পাখি আক্তার জানান, ডেমরা বামৈলের ব্যাংক কলোনিতে মাছের খামারে ছিলেন তার স্বামী। সেখানে পুলিশ ফোর্সের একটি গাড়ি এসে তার স্বামীর দেহ তল্লাশি শুরু করে। এরপর কোনো কিছু না পেয়ে বলে থানায় চলেন। থানায় নেওয়ার পর তাকে লকআপে আটকে মামলা দিয়ে চালান দেয়।

৫ জানুয়ারি পুরান ঢাকার সূত্রাপুর থানায় একটি মাদক মামলা হয়। মামলার বাদী ওই থানার এএসআই আবুল কালাম আজাদ। গাঁজা বিক্রির অভিযোগে আলামিন নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। আর জব্দ তালিকা প্রস্তুত করেন এসআই আবদুল আউয়াল। মামলায় সাক্ষী করা হয় সদরঘাটের শ্রমিক জনি ফরাজী ও পানি বিক্রেতা শরীফকে। জনি ফরাজী এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি ওই দিক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। তখন এক পুলিশ আমাকে ডেকে নিয়ে নাম-ঠিকানা লিখে রাখে। গাঁজা ধরা নিয়ে আমি কিছুই জানি না। মামলার বিষয়েও জানি না।’ শরীফ বলেন, ‘আমি সূত্রাপুর থানার সোর্স হিসেবে কাজ করি। আমাকে কোনো টাকা-পয়সা দেয় না। আমাকে কেমনে সাক্ষী বানাইছে কিছু জানি না।’

আইনজ্ঞদের ভাষ্য : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এসব মাদক মামলায় যিনি জব্দ করেন তিনিই এজাহার করেন। অনেক সময় আবার তিনিই তদন্ত করেন। এতে সঠিক বিচার পাওয়া যায় না। ঘটনাস্থলের নিরপেক্ষ এবং সঠিক সাক্ষী না রাখলে যিনি অপরাধী তিনি সুবিধা পাবেন আর নিরপরাধ ব্যক্তি হয়রানির শিকার হবেন। আর সাক্ষী বানাতে হবে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী। ডেকে এনে যাকে সাক্ষী বানানো হবে তিনি তো ভুয়া সাক্ষীই। তবে ভুয়া সাক্ষী দিয়ে মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ঘটনা বেশি।’ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির মহাসচিব ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘এ মামলাগুলোয় আইনের যথাযথ পদ্ধতি অনুসৃত হয় না। এ মামলায় সাক্ষীদের যেভাবে সাক্ষ্য নেওয়া হয় তা মানা হয় না। এও ঠিক যে পুলিশ কারও পকেটে মাদক ঢুকিয়ে দিয়ে ফাঁসিয়ে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে এটা হয়, কিন্তু সব ক্ষেত্রে না।’

অনুসন্ধানে আরও যা জানা যায় : পুরান ঢাকার সূত্রাপুর থানায় যথাক্রমে ৫, ২৫, ৩০ ও ৩১ জানুয়ারি আরও চারটি মামলা হয়। যার নম্বর যথাক্রমে ৮, ২৮, ৩৫ ও ৩৯। প্রতিটি মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে একই ব্যক্তিকে। তার নাম জাহাঙ্গীর ওরফে বোঁচা। পিতা মৃত নায়েব আলী, মাতা সখিনা বেগম। ঠিকানা ১৭/১ ওয়াল্টার রোড, সূত্রাপুর। তার মোবাইল নম্বরে কল করা হলে বন্ধ পাওয়া যায়। জাহাঙ্গীর ছাড়াও ৪ জানুয়ারি একই থানায় ৬১ নম্বর মামলা, ৩০ জানুয়ারির ৩৫ নম্বর মামলা এবং ২৫ জানুয়ারি ২৮ নম্বর মামলায়ও সাক্ষী বানানো হয়েছে একই ব্যক্তিকে। তার নাম ইমন মৃধা। বাবা মৃত মাসুদ মৃধা, মা রাশেদা বেগম। বাড়ি কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার শিবনগর গ্রামে। এ বিষয়ে জানতে ইমনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ভাই, এখন ব্যস্ত আছি, ফোন রাখেন।’

ফৌজদারি কার্যবিধিতে যা বলা আছে : ১০৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোথাও তল্লাশি চালানোর আগে ওই এলাকার দুজনের বেশি সম্মানিত বাসিন্দাকে হাজির করতে হবে এবং তারা সাক্ষী হবেন। ২ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে, জব্দ তালিকায় ওই ব্যক্তিরা স্বাক্ষর করবেন।

মিলছে ভুয়া মাদকও : পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৫ সাল থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৪২ হাজার ১৮০টি মাদক আলামত পরীক্ষা করেছে সংস্থাটির কেমিক্যাল ল্যাব। তবে গত বছরের দুটি মাদক মামলার আলামত এবং চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ১ হাজার ৪২৪টি আলামত পরীক্ষার ফল এখনো পাওয়া যায়নি। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, সব মাদক পরীক্ষার রিপোর্ট পজিটিভ আসে না, নেগেটিভও পাওয়া যায়।

দীর্ঘ সময়েও শেষ হচ্ছে না মাদক মামলার বিচার : সাক্ষীর অভাবে বছরের পর বছর চলছে মাদক মামলার বিচার। ২০১৭ সালের ৫ মার্চ রাতে রাজধানীর শাহজাদপুরের একটি ভবনের চতুর্থ তলার ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে ৪২ হাজার ৫০০ পিস ইয়াবা জব্দ করে গুলশান থানা পুলিশ। ওই বছরের ৩০ মে মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করে পুলিশ। ৫ জুন তা গ্রহণ করা হয়। এ মামলায় গ্রেফতার আসামি ছিলেন আবুল বাশার। আর পলাতক দেখানো হয় জাকির হোসেন, হারুনসহ আরও দুজনকে। আদালতসূত্র জানিয়েছেন, এ মামলাটি এখনো সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।

এ মামলার অন্যতম সাক্ষী মনোয়ার হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এ মামলায় আমি সাক্ষ্য গ্রহণের বিষয়ে কিছুই জানি না। মামলাটি কী অবস্থায় তা-ও জানি না। এমনকি আমাকে সাক্ষী করার বিষয়েও আমি কিছু জানি না।’ ২০১৯ সালের ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় দেশের নিম্ন আদালতে ১ লাখ ৭০ হাজার ২৪২টি মাদক মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে ৩১ হাজার ১৫৩টি পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি বছরের হিসাবে সেই সংখ্যা অনেকটা কমে আসবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর