বুধবার, ৫ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

মাঠে বিরোধ বাড়াচ্ছেন মন্ত্রী-এমপিরা

ইউপির মনোনয়নে তৃণমূলের সঙ্গে বাড়ছে দূরত্ব, মতামত প্রকাশের সুযোগ নেই মাঠে, বেড়েছে খুনোখুনি সহিংসতা, ইসির নির্দেশ অমান্য করে অনেক এমপির অবস্থান এলাকায়

রফিকুল ইসলাম রনি

মাঠে বিরোধ বাড়াচ্ছেন মন্ত্রী-এমপিরা

চলমান ইউনিয়ন পরিষদ ও মেয়াদোত্তীর্ণ পৌরসভা নির্বাচন ঘিরে মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের দূরত্ব ও বিরোধ বেড়েছে। ব্যক্তিস্বার্থের কাছে উপেক্ষিত তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মতামত। অনেক এলাকায় মাঠের মতামত ছাড়াই মন্ত্রী-এমপি ও গুরুত্বপূর্ণ নেতারা তাদের ব্যক্তিগত পছন্দের একজনের নাম পাঠিয়েছেন কেন্দ্রের কাছে। আবার কিছু এলাকায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কেউ নির্বাচনে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলে কঠোরভাবে দমন করা হয়েছে। ভোট ঘিরে উভয় পক্ষের হানাহানি-সংঘাত ব্যাপক রূপ ধারণ করেছে। এতে মারা গেছেন অর্ধশতাধিক মানুষ। যার বড় অংশই আওয়ামী লীগের মাঠের কর্মী। অন্যদিকে মামলার আসামি হয়েছেন আওয়ামী লীগের সারা দেশের ৫০ হাজারের বেশি মাঠকর্মী। অনেক কর্মী মামলা মাথায় নিয়ে এখন এলাকাছাড়া। মাঠ পর্যায়ের এ অবস্থানকে দলের জন্য কঠিন বিব্রতকর মনে করছেন আওয়ামী লীগের সমর্থক-নেতা-কর্মীরা। জানা গেছে, অধিকাংশ এলাকার মন্ত্রী-এমপিরা নিজের প্রভাববলয় ধরে রাখতে প্রশাসনকেও ব্যবহার করেছেন দলের বিরুদ্ধে। অনেকে আবার আত্মীয়স্বজন ও ‘ভাই লীগ’কে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে গিয়ে ত্যাগীদের করেছেন উপেক্ষা। এ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে- নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন তাদের কথার বাইরে যায়নি।

এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে নিজেদের প্রণীত আইন নিজেরাই মানছেন না মন্ত্রী-এমপিরা (আইনপ্রণেতা)। অর্ধশতাধিক আইনপ্রণেতার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে। বিধি লঙ্ঘন করে নির্বাচনী প্রচারে নেমে এলাকাবাসীর তোপের মুখে পড়েছেন অনেকে। আবার কেউ কেউ নির্বাচন কমিশন থেকে পেয়েছেন এলাকাছাড়ার নোটিস। নির্বাচনী এলাকার প্রতিপক্ষ প্রার্থী, গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এসব এমপিদের চিঠি দিয়ে কড়া সতর্ক করেছে নির্বাচন কমিশন। ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা (নির্বাচন আচরণ) বিধিমালায় সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীর নির্বাচনী  প্রচারণা এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধা ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এতে বলা হয়েছে- সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, চিফ হুইপ, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সিটি করপোরেশনের মেয়ররা নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন না। তিনি সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটার হলে কেবল ভোট প্রদানের জন্য কেন্দ্রে যেতে পারবেন। এ ধারা অনুযায়ী নির্বাচনে প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণায় নেমে আইন ভঙ্গ করছেন সংসদ সদস্যরা। এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সভাপতি বদিউল আলম মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নির্বাচনের সময় আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়টি দেখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু তারা দেখেও দেখে না। শুনেও শোনে না। তারা কানে দিয়েছে তুলো, চোখে পড়েছে ধুলো। ফলে অহরহ আইন ভঙ্গের ঘটনা ঘটছে। যারাই ক্ষমতায় যায় তাদের অনেকেই প্রতি পদে আইন লঙ্ঘন করে। আমাদের দেশের যারাই আইনপ্রণেতা রয়েছেন তাদের সঠিক কাজটা কী তা-ও হয়ত অনেকে জানেন না। জানলেও মানতে চান না। তারা স্থানীয় পর্যায়ে জমিদারের ভূমিকা পালন করেন। রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে আইনের শাসন অনুপস্থিত। আমাদের দেশে আইনের শাসন অনেক কারণে বাস্তবায়ন হয় না। কারণ হয়তো, আইনটি জনস্বার্থের জন্য হয় না। আবার জনস্বার্থে করা হলেও দলীয় স্বার্থ বা গোষ্ঠী স্বার্থের কারণে বাস্তবায়ন করা হয় না।’ ইসি-সূত্র জানান, ইতোমধ্যে যেসব সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আইন ভঙ্গের অভিযোগ পাওয়া গেছে তারা হলেন- মৌলভীবাজার-৪ আসনের উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ (সাবেক চিফ হুইপ), কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের মো. আফজাল হোসেন, কক্সবাজার-১ আসনের জাফর আলম, সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের তানভীর ইমাম, পটুয়াখালী-৩ আসনের এস এম শাহজাদা, নেত্রকোনা-৫ আসনের ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল, গাজীপুর-৩ আসনের ইকবাল হোসেন সবুজ, শরীয়তপুর-৩ আসনের নাহিম রাজ্জাক, সংরক্ষিত নারী আসনের (৩৩৮) ফেরদৌসী ইসলাম জেসি, শামীমা আক্তার খানম, নাটোর-১ আসনের শহিদুল ইসলাম বকুল, নাটোর-৪ আসনের আবদুল কুদ্দুস, নাটোর-২ আসনের শফিকুল ইসলাম শিমুল ও নাটোর-নওগাঁ (৩৪৩) আসনের সংরক্ষিত নারী আসনের রত্না আহমেদ।

 

নির্বাচনী আচরণবিধি ভেঙে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের রহিমপুর ইউনিয়নে ছোট ভাইয়ের পক্ষে ভোটের মাঠে নেমে তোপের মুখে পড়েন মৌলভীবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য, সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ। এ সময় বিদ্রোহী প্রার্থীর অনুসারীরা এমপি শহীদকে অবরুদ্ধ করে রাখেন। একপর্যায়ে নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী কার্যালয় এবং এমপির গাড়িবহরে হামলা চালানো হয়। রবিবার রাত ১০টার দিকে কমলগঞ্জের মুন্সীবাজারে এ ঘটনা ঘটে। পরে এ ঘটনার জেরে আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে এমপির গানম্যান, এপিএস, গাড়িচালকসহ অন্তত ১৫ জন আহত হন। পুলিশ গিয়ে জনতার তোপ থেকে এমপিকে উদ্ধার করে আনে। কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য মো. আফজাল হোসেন তৃতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে প্রার্থীদের পক্ষে সরাসরি প্রচারণায় নামেন। এজন্য নভেম্বরে তাকে এলাকাছাড়ার নির্দেশ দিয়ে চিঠি দেয় নির্বাচন কমিশন। নভেম্বরে কয়েকটি ইউনিয়নে নৌকার পক্ষে একাধিক জনসভা ও মাঠে ভোট চান রাজশাহী-৩ আসনের সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিন। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মোহনপুরের রায়ঘাঁটি ইউপি নির্বাচন উপলক্ষে বড়াইল উচ্চবিদ্যালয় মাঠে এক সভায় যোগ দিয়ে ভোট চান তিনি। একইভাবে ১১ ডিসেম্বর নাটোরের কান্দিভিটুয়ায় জেলা আওয়ামী লীগের অস্থায়ী কার্যালয়ে পৌর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় সদর পৌরসভায় নৌকার প্রার্থী উমা চৌধুরী জলির পক্ষে ভোটে চান আওয়ামী লীগের তিন এমপি। এরা হলেন- নাটোর-৪ আসনের সংসদ সদস্য, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুল কুদ্দুস, নাটোর-২ আসনের সংসদ সদস্য, জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শিমুল ও নাটোর-নওগাঁ (৩৪৩) আসনের সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য, জেলা মহিলা লীগ সভানেত্রী রত্না আহমেদ। ১৬ জানুয়ারি সদর পৌরসভার নির্বাচন। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়ে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে বিতর্কে জড়ান এমপি তানভীর ইমাম। ৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগ মনোনীত তিন প্রার্থীর পক্ষে তিনটি পৃথক সমাবেশে সরাসরি অংশ নিয়ে ভোট চান তিনি। উল্লাপাড়া সদর ইউনিয়নের বাকুয়া গ্রামে দুপুরে দলীয় প্রার্থী আবদুস সালেক, বিকালে বড় পাঙ্গাসী ইউনিয়নে হুমায়ুন কবির লিটন এবং সন্ধ্যায় সলপ ইউনিয়নে প্রকৌশলী শওকাত ওসমানের পক্ষে সমাবেশ করেন তানভীর ইমাম। সব সমাবেশেই তিনি সরাসরি নৌকার পক্ষে ভোট চান এবং বিদ্রোহী প্রার্থীদের তুলাধুনা ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন। কক্সবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলমকেও নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে ২৫ ডিসেম্বর এলাকাছাড়ার নির্দেশ দেয় নির্বাচন কমিশন।

সর্বশেষ খবর