শুক্রবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

সবাই হতে চান নির্বাচন কমিশনার

নাম জমা দেওয়ার হিড়িক, আজ বিকাল ৫টা পর্যন্ত জমা দেওয়া যাবে

উবায়দুল্লাহ বাদল

নতুন নির্বাচন কমিশনে (ইসি) স্থান পেতে উদগ্রীব দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত তিন শতাধিক ব্যক্তি ইসিতে জায়গা পেতে অনলাইন কিংবা সশরীরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে হাজির হয়ে জীবনবৃত্তান্ত জমা দিয়েছেন। এদের মধ্যে সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলা, বিচারক, শিক্ষক, সিনিয়র সাংবাদিক যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছে ‘বাংলাদেশ মেস সংঘ’-এর প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিবের নামও। নিজের নাম যেন সম্ভাব্য ইসিতে স্থান পায় সে জন্য চাকরিজীবনের সফলতা, বিএনপি-জামায়াত আমলে লাঞ্ছনা-বঞ্চনার ফিরিস্তি তুলে ধরতেও ভুলছেন না অনেকে। যেন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বঞ্চিত হওয়ার কারণেই তার ইসিতে নিয়োগ পাওয়া উচিত। কেউ কেউ আবেদন গ্রহণকারী কর্মকর্তাদের কাকুতি-মিনতি করে বলেছেন, ‘আমার নামটা যেন তালিকায় ওঠে’। বিশেষ করে সাবেক আমলাদের অনেকে বর্তমান সরকারের জন্য কত ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করেছেন তাও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা প্রায় অভিন্ন ভাষায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নতুন ইসির জন্য নাম জমা দেওয়ার হিড়িক পড়েছে। যেন সবাই ইসি হতে চান। এদিকে নতুন ইসির জন্য নাম জমা দেওয়ার সময়সীমা শেষ হচ্ছে আজ শুক্রবার বিকাল ৫টায়। এরপর ওই সব নাম নিয়ে কাল শনিবার বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত এবং বেলা পৌনে ১টা থেকে সোয়া ২টা পর্যন্ত দেশের বিশিষ্ট নাগরিক, পেশাজীবী,  সাংবাদিকসহ গণমান্য যারা আছেন, তাদের সঙ্গে বৈঠক হবে। এরপর রবিবার বিকালে আরও একটি বৈঠক করবে সার্চ কমিটি। কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি। ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ অনুসারে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করে ৫ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। আইন অনুযায়ী কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ পেশ করতে হবে। কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দিচ্ছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ফলে নির্বাচন কমিশনার হতে আগ্রহীদের নাম জমা দিতে হচ্ছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। এ জন্য তারা সরাসরি এবং ই-মেইলের মাধ্যমে আবদন জমা নিচ্ছে। আবেদন জমা নিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের পূর্ব গেটের উল্টোপাশে সচিবালয়ের ৫ নম্বর গেটের দ্বিতীয় তলায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পক্ষ থেকে আলাদা একটি ডেস্ক খোলা হয়েছে। ওই ডেস্কে সরাসরি আবেদন জমা নেওয়া হচ্ছে। দিনে দুবার সেই জমা দেওয়া নামের তালিকা আপডেট করা হচ্ছে।

গতকাল সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি ব্যক্তিপর্যায়ের লোকেরাও সেখানে নামের তালিকা জমা দিচ্ছেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পক্ষ থেকে যারা এসব আবেদন জমা নিচ্ছেন তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, শুধু নামের তালিকা বা আবেদন জমা দিয়েই সংশ্লিষ্টরা ক্ষান্ত হচ্ছেন না, তারা সংশ্লিষ্টদের মোবাইল ফোন নম্বর নিয়ে যাচ্ছেন ফলোআপ করার জন্য। তাদের নাম তালিকায় ওঠানো হচ্ছে কি না তাও জানানোর জন্য তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ। এ ছাড়া যাদের সচিবালয়ে প্রবেশ পাস রয়েছে তারা সরাসরি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আবেদন জমা দিচ্ছেন। কেউ কেউ সংশ্লিষ্টদের নানাভাবে ম্যানেজ করে সচিবালয়ে প্রবেশ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় সরাসরি আবেদন জমা দিয়ে নিজের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ফিরিস্তি তুলে ধরে নিজের প্রস্তাবিত নাম যেন সম্ভাব্য ইসির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় সে ব্যাপারে কাকুতি-মিনতি করতেও ভুল করছেন না। আবার অনেকে গর্বের সঙ্গে নিজের অতীত তুলে ধরে বর্তমান সরকারের জন্য কত ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করেছেন তাও শুনিয়ে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। বিশেষ করে সাবেক আমলাদের অনেকে বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময়ে পদোন্নতি-পদায়ন বঞ্চনার কথা তুলে ধরে নতুন নির্বাচন কমিশনে নিজের অপরিহার্যতার বয়ানও দিচ্ছেন। এমনকি তারা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উদ্দেশে এমন নছিহতও করছেন, যেন তাদের নাম তালিকায় ওঠানো হয়েছে কি না তা জানানো হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, জাসদ (ইনু), বাংলাদেশ কংগ্রেস তাদের প্রস্তাবিত নামের তালিকা জমা দিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। আজ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তরিকত ফেডারেশনের নামের তালিকা দেওয়ার কথা রয়েছে।

ইতোমধ্যে কিছু আলোচিত বিশিষ্ট ব্যক্তির নামও জমা পড়েছে বলে আভাস পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে রয়েছেন আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল এম এ আজিজ, সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন, পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা, মোহাম্মদ শফিউল আলম, নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিব ও বর্তমানে স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ প্রমুখ। সরাসরি প্রস্তাব জমা নেওয়ার দায়িত্বে থাকা একাধিক সূত্র জানায়, বিশিষ্টজনদের নাম ছাড়াও কিছু ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক নামের প্রস্তাবও পাওয়া গেছে। গতকাল দুপুরে আনুমানিক ৩৫ থেকে ৪০ বছর বয়সী একজন খামে করে নাম জমা দিয়ে বের হওয়ার পর এই প্রতিবেদকের এক প্রশ্নের জবাবে জানান, তিনি তার নিজের নাম প্রস্তাব করেছেন। বয়স ৫০ বছর হয়েছে কি না জানতে চাইলে কোনো জবাব না দিয়ে দ্রুত চলে যান তিনি। সার্চ কমিটির কাছে নিজের নাম প্রস্তাব করেছেন বাংলাদেশ মেস সংঘের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব আয়াতুল্লাহ আকতার। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তিনিও ইসিতে স্থান পেতে আগ্রহী। তিনি গত দুবার তার সংগঠনের পক্ষ থেকে ঢাকা সিটির মেয়র পদে নির্বাচন করেছেন। তিনি একজন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। তবে সংশ্লিষ্টরা জানান, যারা আইনানুগ শর্ত পালন করে প্রস্তাব দেবেন তাদের প্রস্তাবগুলোই শুধু সার্চ কমিটির কাছে উপস্থাপন করা হবে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা গতকাল অত্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করেছেন। সংশ্লিষ্ট শাখার বাইরেও অন্যান্য শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সার্চ কমিটির কাজে যুক্ত করা হয়েছে, যাতে কোনো ধরনের ভুলভ্রান্তি না হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শনি ও রবিবারের তিনটি বৈঠকে অংশগ্রহণকারী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আমন্ত্রণপত্র পাঠানো, তারা পেয়েছে কি না তা নিশ্চিত করাসহ নানা কাজে দিনভর ব্যস্ত ছিলেন। যাদের সার্চ কমিটি আমন্ত্রণ জানিয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং বাসসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক, সাহিত্যিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, শিক্ষাবিদ ও গণমাধ্যম গবেষক অধ্যাপক ড. মো. গোলাম রহমান, ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন, অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল, রাজনীতি-বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আসিফ নজরুল, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব এম আবদুল আজিজ, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ, আইনজীবী রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ফিদা এম কামাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, সাংবাদিক আবেদ খান, চ্যানেল২৪-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও দৈনিক সমকালের প্রকাশক এ কে আজাদ, দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তাসমিমা হোসেন, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, একাত্তর টেলিভিশনের সিইও মোজাম্মেল বাবু, সাবেক নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক ও সাখাওয়াত হোসেন, কবি মহাদেব সাহা, প্রজন্ম একাত্তরের সভাপতি আসিফ মুনীর প্রমুখ।

প্রকাশ্যে আনার দাবি আওয়ামী লীগ শরিকদের

তালিকা চেয়ে বিএনপিকে চিঠি সার্চ কমিটির

 

সর্বশেষ খবর