শুক্রবার, ৮ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের আশঙ্কা

পুতিনের দুই মেয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্রের

প্রতিদিন ডেস্ক

দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের আশঙ্কা

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সূত্র ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের দুই মেয়ের ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এই দুই মেয়ের মধ্যে বড়জন মারিয়া ভরোন্তসোভা (৩৬) শিক্ষকতা-গবেষণা করছেন এবং ছোটজন ক্যাটেরিনা তিখোনোভা (৩৫) রক অ্যান্ড রোল নৃত্য শিল্পী হিসেবে পরিচিত। এদিকে একের পর এক রাশিয়াসহ ব্যক্তি-বিশেষের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পাল্লা ভারী হতে থাকায় এবং হুমকি সৃষ্টি করে প্রতিবেশী ইউক্রেনকে ঢালাওভাবে সামরিক সাজ-সরঞ্জাম সরবরাহ করতে থাকায় ইউক্রেন যুদ্ধ অবশেষে দীর্ঘমেয়াদি রূপ নিতে চলেছে। রাশিয়া গতকাল নতুন করে ইউক্রেনের দনবাসে সামরিক অভিযানও শুরু করেছে। সূত্র : বিবিসি, রয়টার্স, স্পুটনিক, আলজাজিরা।

প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ায় রাশিয়া ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। এই ভিডিও ক্লিপে দেখা গেছে, ইউক্রেনের সেনারা তাদের হাতে বন্দি কয়েকজন রুশ সৈন্যকে হাতবাঁধা অবস্থায় গুলি করে হত্যা করছে। ভিডিওটি ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের পশ্চিমে অবস্থিত ‘দিমিত্রিওকা’ গ্রাম থেকে ধারণ করা হয়েছে। ভিডিওতে ইউক্রেনের এক সেনাকে বলতে শোনা যায়, ‘সে (রুশ সেনা) এখনো বেঁচে আছে! এই ডাকাতের ছবি তোল! সে এখনো নিঃশ্বাস নিচ্ছে।’ এরপর ইউক্রেনের এক সেনা ওই আহত রুশ সৈন্যকে তাক করে দুই রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এ সময় রুশ সৈন্যের দেহ কেঁপে ওঠার পর তার শরীরে আরও দুই রাউন্ড গুলিবর্ষণ করা হয়। এই ভিডিওতে পেছনে হাত বাঁধা অন্তত তিনজন রুশ সেনার নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। উল্লেখ্য, যুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষের বন্দি সেনাদের হত্যা করাকে আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। সবকিছু মিলিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন গতকাল হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবানের সঙ্গে এক টেলিফোনালাপে বলেছেন, ইউক্রেনের কর্তৃপক্ষ রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘অমার্জিত ও নিন্দনীয় উসকানি’ দিয়ে যাচ্ছে। তিনি বুচা শহরের হত্যাকান্ড নিয়ে মিথ্যা প্রচারণারও কঠোর সমালোচনা করেন। পুতিনের সঙ্গে টেলিফোনালাপের পর হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ওরবান ইউক্রেনের বুচা শহরের বেসামরিক নাগরিকদের হত্যাকান্ড নিয়ে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানান। তিনি বুদাপেস্টে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা তথ্য বিকৃতির এমন এক যুগে বসবাস করছি, যখন নিজের চোখকে বিশ্বাস করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।’

 

নতুন করে রুশ হামলা : রুশ বাহিনী পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনের নগরীগুলোতে অবিরাম বোমাবর্ষণ শুরু করেছে। খবরে বলা হয়, অনেক জায়গাকে টার্গেট করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে রুশ বাহিনী। ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী খারকিভে গত রাতভর তুমুল গোলাবর্ষণ হয়েছে। লুহানস্ক এবং দোনেৎস্ক অঞ্চলেও আরও গোলা হামলা হচ্ছে। ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফের মতে, রাশিয়া ইউক্রেনের সেনা অবস্থানগুলোসহ পূর্বাঞ্চলের লুহানস্ক এবং দোনেৎস্ক অঞ্চলের বরিভস্ক, নোভোলুহান্সকে, সোলোদকে, মারিঙ্কা ও জোলোটা নিভার বেসামরিক অবকাঠামোকে হামলার নিশানা করেছে। রুশ বাহিনী ?পুরো দনবাস নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য ইউক্রেন বাহিনীকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে। দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক নিয়ে এই অঞ্চল গঠিত। পশ্চিমা গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের কাছে লড়াইয়ে সুবিধা করে উঠতে না পেরে রুশ বাহিনী এখন পূর্ব ইউক্রেনে মনোনিবেশ করেছে। দনবাসে রাশিয়ার এই অভিযান দীর্ঘ সংঘাতে রূপ নিতে পারে। কিয়েভ বলছে, এখন রুশ সেনাদের প্রধান লক্ষ্য হলো দনবাস অঞ্চলে ইউক্রেনীয় বাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যূহ ভেঙে দেওয়া। মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগন বলেছে, ইউক্রেন যুদ্ধে এখন দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে রাশিয়া। এ কারণে ইউক্রেনের কিয়েভ ও চেরনিহিভ অঞ্চল থেকে রুশ বাহিনীকে পুরোপুরি সরিয়ে নিয়েছে মস্কো। যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও প্রায় একই কথা বলছে। যুক্তরাজ্যের ভাষ্য, দনবাস অঞ্চলে রাশিয়ার গোলা ও বিমান হামলা অব্যাহত আছে। রাশিয়া এখন পূর্ব ইউক্রেনে সামরিক অভিযান জোরদারের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। এদিকে রুশ হামলা জোরদারের আশঙ্কায় দনবাস অঞ্চল থেকে হাজারো মানুষ পালাচ্ছেন। ইউক্রেনের কর্তৃপক্ষ জীবন বাঁচাতে অঞ্চলটির লোকজনকে পালানোর আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলে রুশ হামলা জোরদার করায় ওইসব এলাকা ছেড়েও পালাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। দনবাস থেকে পালানোর চেষ্টায় থাকা মানুষজন দিনের পর দিন উত্তরের ক্রামাতোরস্ক কেন্দ্রীয় স্টেশনে ভিড় জমাচ্ছেন। অনেকেই পেছনে ফেলে যাওয়া প্রিয়জনদের বিদায় জানাচ্ছেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউক্রেনীয়দের জীবন রক্ষায় আরও অস্ত্র দেওয়ার জন্য ন্যাটো দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি ইউক্রেনকে রক্ষায় কীভাবে সর্বোত্তম সহায়তা করা যায়- তা নির্ধারণে ব্রাসেলসে ন্যাটোর সদস্যদেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা গতকাল দ্বিতীয় দিনের মতো আলোচনা করেছেন। খবরে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর কিছু সদস্যকে ‘সুইচ ব্লেড ড্রোন’ চালানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। অত্যাধুনিক এই ড্রোন দিয়ে ট্যাংক ধ্বংস করা সম্ভব। পেন্টাগনের এক কর্মকর্তা স্থানীয় সময় গত বুধবার বলেছেন, ওয়াশিংটন এ ধরনের ড্রোনগুলো কিয়েভে সরবরাহ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের মুখপাত্র জন কিরবি বলেছেন, ইউক্রেনের অল্প কিছু সেনাসদস্য যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন। রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর আগে থেকেই এই সেনারা যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। কিরবি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ইউক্রেনের সেনাদের থাকার সুযোগটাই তারা নিয়েছেন। এই সেনাদের যুক্তরাষ্ট্র সুইচ ব্লেড ড্রোন চালানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, যাতে তারা দেশে ফিরে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে পারেন। কিরবি বলেন, রাশিয়ার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করতে ১০০টি ড্রোন পাঠানো হয়েছে। এগুলো দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ড্রোনগুলো লক্ষ্যবস্তুতে বিস্ফোরিত হয়। কিরবি আরও বলেন, ১২ জনেরও কম ইউক্রেনীয় সেনাকে ড্রোন চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তারা এ সপ্তাহের শুরুতে সেখানে পৌঁছেছেন।

পুতিনের দুই মেয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা : রাশিয়া এবং প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের ওপর অর্থনৈতিক চাপ আরও বাড়াতে তার দুই মেয়ের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গত বুধবার ঘোষিত নতুন নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের দুই প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েসহ দুটি বৃহত্তম ব্যাংক, কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি, রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের স্ত্রী এবং মেয়ে। ঊর্ধ্বতন এক মার্কিন প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা রাশিয়ার বৃহত্তম আর্থিক প্রতিষ্ঠান সার্বব্যাংক এবং বৃহত্তম প্রাইভেট আলফা ব্যাংকের ওপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে নাটকীয়ভাবে অর্থনৈতিক চাপ বাড়াচ্ছি।’ তিনি পুতিনের দুই মেয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গে বলেন, ‘পুতিন তার কিছু সম্পদ এই মেয়েদের নামে লুকিয়ে রেখেছেন- এমন বিশ্বাস থেকেই যুক্তরাষ্ট্র তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।’ তবে পুতিন তার কোনো সম্পদ দুই মেয়ে মারিয়া পুতিনা ও ক্যাটেরিনা তিকোনোভার নামে লুকিয়ে রেখেছেন- সে ব্যাপারে কিছু না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘রুশ এলিটদের মধ্যে এরকম চর্চা আছে। পুতিন, তার সহযোগীদের অনেকে এবং ধনকুবেররা তাদের সম্পদ লুকান। এ বিষয়টির আলোকেই এ নিষেধাজ্ঞা।’ ঊর্ধ্বতন ওই মার্কিন প্রশাসনিক কর্মকর্তা জি-৭ এবং ইইউ-এর ব্যবস্থাপনায় রাশিয়ায় কোনোরকম নতুন বিনিয়োগের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একটি নির্বাহী আদেশ সই করার পর রাশিয়ার ওপর এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে। রাশিয়ার অন্যান্য যেসব ব্যক্তি নতুন নিষেধাজ্ঞা কবলিত হয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন, সাবেক রুশ প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভসহ দেশটির নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা এবং প্রধানমন্ত্রী মিখাইল মিশুস্তিন। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র এর আগে ১৪০ জনের বেশি রুশ ধনকুবের এবং তাদের পরিবারের সদস্যসহ ৪ শতাধিক রুশ সরকারি কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

সর্বশেষ খবর