শুক্রবার, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ছিনতাই-মারধরই স্বাভাবিক!

♦ ছাত্রলীগের পদবি ব্যবহার করে চলে এসব অপরাধ ♦ ঘটনা আমলেই নেয় না ছাত্রলীগ

নাসিমুল হুদা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মারধর ও শ্লীলতাহানি যেন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সংঘবদ্ধ ছিনতাই-চাঁদাবাজির মতো অপরাধে জড়াচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের পরিচয় ব্যবহার করে এসব কর্মকাণ্ড করছেন তারা। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এমন অভিযোগে কয়েকজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে অভিযুক্তরা ছাত্রলীগের পদবি ব্যবহার করে অপরাধ করলেও একটি ঘটনাও আমলে নেয়নি ছাত্রলীগ। ফলে চাঁদাবাজি-ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়ছে।

গত ৪ ফেব্রুয়ারি এক দম্পতিকে মারধর, ২২ হাজার টাকা ও এটিএম কার্ড ছিনতাইয়ের অভিযোগে ১৪ জনের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় একটি মামলা হয়। এজাহারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ফাহিম তাজওয়ার জয় এবং তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাজিদ আহমেদের নাম উল্লেখ করা হয়। তারা দুজনই সূর্যসেন হল শাখা ছাত্রলীগের সদস্য। এ ঘটনার পরদিন রাতে বুয়েটে একটি কাভার্ড ভ্যানে চাঁদাবাজির সময় আটক হন থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের ফজলে নাবিদ সাকিল, ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মো. রাহাত রহমান ও সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাদিক আহাম্মদ। তারা তিনজনই ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। অভিযুক্তদের মধ্যে সাকিল ও সাদিক বিজয় একাত্তর হল ছাত্রলীগের সক্রিয়কর্মী। সর্বশেষ, গত মঙ্গলবার রাতে প্রাইভেট কার চালককে মারধর ও ৩২ হাজার টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগে ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির শিক্ষার্থী নাজমুল হাসান রুপু এবং পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের তারিক হাসানসহ ১০-১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। রুপু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের উপ-মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পাদক। তারিক ফজলুল হক ছাত্রলীগের কর্মী। তবে, অভিযোগ অস্বীকার করলেও এ টাকার একটি অংশ আত্মসাতের বিষয়টি দুজনই স্বীকার করেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছিনতাইয়ের এসব ঘটনা ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করায় সামনে এসেছে। কিন্তু অভিযোগ সামনে আসেনি এমন ঘটনাই বেশি। ক্যাম্পাসে ছিনতাই ‘রোজকার ঘটনা’য় পরিণত হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছিনতাইয়ের শিকার এক ভুক্তভোগী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তিনি তার প্রেমিকাসহ সেখানে বেড়াতে এসেছিলেন। ছিনতাইয়ের শিকার হলেও তিনি থানায় বা বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযোগ করেননি। কারণ, অভিযোগ করলেই বিচার হবে, এমন বিশ্বাস নেই তার।

যেভাবে হয় ছিনতাই-চাঁদাবাজি : সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ছিনতাই ও চাঁদাবাজির সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া ক্যাম্পাসের দোয়েল চত্বর, শহীদ মিনার ও ফুলার রোড, ভিসি চত্বর এলাকাতেও ছিনতাই-চাঁদাবাজি হয়। এ জায়গাগুলোতে দিনে ছিনতাই কম হয়। তবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দিনের বেলাতেও একাধিক ছিনতাইয়ের তথ্য আছে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছিনতাইয়ের সময় নিজেদের ছাত্রলীগের নেতা পরিচয় দিয়ে ‘টার্গেটকৃত ব্যক্তি ক্যাম্পাসের কিনা’ এমন প্রশ্ন করে চক্রটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক বা বর্তমান শিক্ষার্থী না হলে রীতিমতো হেনস্তা করে সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া হয়। তবে, ইদানীং ক্যাম্পাসের সাবেক শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও এমন ঘটনা ঘটেছে। প্রাইভেট কার ছিনতাইয়ে ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে চক্রটি। নিজেদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ইচ্ছা করেই কোনো গাড়ির সঙ্গে লাগিয়ে দেয়। এতে মোটরসাইকেলের সামান্য ক্ষতি হলেও ক্ষতিপূরণ বাবদ মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে চক্রের সদস্যরা। এ ছাড়া ক্যাম্পাসে ‘বাস ধরে নিয়ে চাঁদাবাজি’র সংস্কৃতি বেশ পুরনো। এসব চাঁদার একটি বড় অংশ চলে যায় হল ছাত্রলীগের নেতাদের পকেটে। সাধারণত ক্যাম্পাসের আশপাশের রাস্তা দিয়ে চলা লোকাল বাসে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ঝামেলা হলে সেগুলোকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে বাধ্য করে তারা। এমন বাস ফেরত নিয়ে যেতে নেতাদের ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা বা তার বেশি চাঁদা দিতে হয় বাসমালিকদের।

বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা নিলেও নেয় না ছাত্রলীগ : এসব ঘটনায় সাধারণত অভিযোগ আসা সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার নজির আছে। তবে, ঘটনার পরিমাণের তুলনায় তা ‘কম’ বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তবে সম্প্রতি সামনে আসা একাধিক ছিনতাই ও চাঁদাবাজির অভিযোগে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় ও হল শাখার নেতা-কর্মীদের নাম এলেও তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ব্যবস্থা নেয়নি সংগঠনটি। ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের উপদফতর সম্পাদক আকতারুল করিমকে বহিষ্কার করে ছাত্রলীগ। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের এ শিক্ষার্থী দীর্ঘদিন ধরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মাদক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ ও ছিনতাইয়ে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। ২০২১ সালে শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটের এক কর্মচারীকে মারধর ও চাঁদাবাজির মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হলে গণমাধ্যমে তাকে নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়। এরপর তাকে বহিষ্কার করে ছাত্রলীগ। তবে ছিনতাইয়ের সঙ্গে ছাত্রলীগ করার কোনো সম্পর্ক দেখেন না ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। তিনি বলেন, ছিনতাই একটি ফৌজদারি অপরাধ। এর সঙ্গে কোনো সংগঠনের সাথে জড়িত থাকা সম্পর্কযুক্ত নয়। বরং ছাত্রলীগ এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাযহারুল কবির শয়ন বলেন, ছাত্রলীগ কাউকে বিশৃঙ্খলা বা একাডেমিক কার্যক্রম বিনষ্ট হয়, এমন নির্দেশনা দেয় না। কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে ছাত্রলীগের সুনাম ক্ষুণ্ন করার জন্য এসবে জড়ায়। আমরা তাদের প্রতি শূন্য সহিষ্ণুতা দেখিয়েছি। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোও তারা পর্যবেক্ষণ করছেন বলেও জানান শয়ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় এসব বিষয়কে কঠোর দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে পদক্ষেপ নিচ্ছি। গত এক সপ্তাহের মধ্যে আমরা বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে শাস্তি দিয়েছি। অন্যদিকে, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকেও ব্যাপারগুলোতে পদক্ষেপ নিতে বলা হচ্ছে। আমরা ভুক্তভোগীদের বলব, আপনারা আমাদের ওপর আস্থা রেখে অভিযোগ দিন।’

শিক্ষার্থীরা কেন ছিনতাইয়ে জড়াচ্ছে : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কেন অপরাধে জড়াচ্ছে- এমন প্রশ্নের উত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন শাহারিয়া আফরিন বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শিক্ষার্থীরা ‘ফ্যামিলি গাইডেন্সে’র বাইরে থাকে। এর ফলে পারিবারিক বন্ধন কমে গেলে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে। কেউ যখন মনে করে, কোনো অপরাধ করলে ঝুঁকি নেই বা কারও কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে না, তখন সে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যেতে পারে।’ এমন অপরাধ প্রতিরোধে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা জোরদার, শাস্তি নিশ্চিত ও অপরাধ থেকে দূরে রাখতে সচেতনতা বৃদ্ধির পরামর্শ দেন তিনি।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর