সোমবার, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

রাষ্ট্রভাষা বনাম রাষ্ট্রের ভাষা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

রাষ্ট্রভাষা বনাম রাষ্ট্রের ভাষা

রাষ্ট্রের ভাষা এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলা যে সব সময়ে কিংবা হুবহু এক হবে এমন কোনো কথা নেই। এটা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বেশ বোঝা যায়, এ-রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা, সংবিধান তা-ই বলছে, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা ও বোঝা যায় যে, রাষ্ট্রের ভাষা ঠিক বাংলা নয়, অন্য কিছু। এটি অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়, এমনটা প্রায়ই ঘটে, দেখা যায় রাষ্ট্রের একটা নিজস্ব ভাষা রয়ে গেছে। বিশেষ করে রাষ্ট্র যদি হয় কর্তৃত্বপরায়ণ এবং বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থসংরক্ষণকারী। আমাদের রাষ্ট্রের কর্মকর্তা যাঁরা তাঁরা যে বাংলা চর্চা করেন, কিংবা তাঁরা যে বাংলার পক্ষের লোক তা নয়। উচ্চপদে আসীন অসামরিক আমলারা ইংরেজিই পছন্দ করেন, কথাবার্তায় তো বটেই, এমনকি দাফতরিক কাজেও। সামরিক আমলাতন্ত্র ইংরেজি ব্যবহারেই অভ্যস্ত। আমাদের এই স্বাধীন রাষ্ট্রকে বিশ্ব পুঁজিবাদের যে-রাষ্ট্রভাষা, অর্থাৎ ইংরেজি, সে-ভাষাটাকেই ব্যবহার করতে হয়। পররাষ্ট্র ও অর্থমন্ত্রী লজ্জায় পড়েন, ইংরেজিতে চৌকশ না হলে। বড় ব্যবসায়ীদের ব্যবসা অচল ইংরেজির মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ স্থাপনে অসমর্থ হলে। বাংলাদেশে এখন লগ্নি পুঁজির অপ্রতিহত দৌরাত্ম্য, এই পুঁজি বাঙালিকে অবশ্যই ব্যবহার করবে, কিন্তু বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করবে না, পারতপক্ষে। আমাদের রাষ্ট্র জনগণের নিজের হস্তক্ষেপে গড়া, কিন্তু-এ রাষ্ট্র জনগণের নয়, এর কাজ ধনীদের স্বার্থকে পুষ্ট ও রক্ষা করা। বাংলাদেশের ধনীদের জীবনে বাংলা ভাষার ব্যবহার কীভাবে সংকুচিত হচ্ছে এবং ঈশ্বর সহায় হলে আরও যে হতে থাকবে তার জন্য কোনো জরিপ বা গবেষণার আবশ্যকতা নেই, রাজধানীতে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর সামনে রোজ সকালে গাড়ির উপচে পড়া ভিড় দেখলেই টের পাওয়া যাবে, হাড়ে হাড়ে।

আসল কথা এই যে, রাষ্ট্রের নিজস্ব যে-ভাষা সেটা যে বাংলা হবে এমন সম্ভাবনা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না, অত্যন্ত আশাবাদী মানুষও আশার এই আলোকবর্তিকাকে উজ্জ্বল করে তোলা যাবে বলে ভরসা করছেন না। এমনকি রাষ্ট্রের ওই ভাষা যদি বাংলাও হতো তাহলেও তা বাংলা হতো না, কেননা ভাষা তো কেবল শব্দ বা বাক্য নয়, তার একটা স্বরও আছে। ভাষাকে সম্পূর্ণত অর্থনির্ভর বলা যাবে না, সে স্বরনির্ভরও বটে। যে রাষ্ট্র হুংকার, ধমক, হুকুম ইত্যাদি দেয়, আশ্রয় না-দিয়ে ভয় দেখায়, দরিদ্রকে আরও দরিদ্র করে, তার ভাষা বাংলা হলেও বাংলা হবে না; রাক্ষস ভূত-প্রেত কিংবা অন্যান্য বৈরী প্রাণীর মাতৃভাষার পক্ষে মানুষের ভাষা হওয়া সম্ভব নয়, তা সে হয় না, হতে চায়ও না। নিম্ন আদালত ও কোর্ট-কাচারিতে অনেককাল ধরেই বাংলা ভাষা চালু আছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য সে-ভাষা ইংরেজি কিংবা তারও আগের ফারসির তুলনায় কম দুর্বোধ্য নয়। তহশিল অফিসের কাগজপত্র বাংলায় লেখা হলেও কৃষকের জন্য সে-ভাষা বিষময়, যে-জন্য দেখা যায়, গ্রামাঞ্চলে কোনো অভ্যুত্থান ঘটলে লোকে তহশিল অফিস পুড়িয়ে দিতে আগ্রহী হয়, ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের সময় যেমনটি দেখা গেছে। উচ্চতর আদালতের ভাষা এখনো ইংরেজিই রয়ে গেছে, তাছাড়া ফাঁসির হুকুম ইংরেজিতে না-এসে বাংলায় এলে ফাঁসির কোনো কোনো ইতরবিশেষ ঘটবে না, এমনকি ফাঁসির দড়ির রংটা যে বদলাবে তাও নয়।

অথচ এই নতুন রাষ্ট্র যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটা তো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই। প্রথমে দাবি ছিল অন্যতম রাষ্ট্রভাষার, অর্থাৎ দুটি রাষ্ট্রভাষা থাকবে পাকিস্তানের, যাদের একটি হবে বাংলা। কিন্তু ওই আন্দোলনের মধ্যে পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলার যে-আকাক্সক্ষাটা ছিল তা ক্রমাগত তীব্র হয়েছে, এবং ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছে। এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে এটা ছিল স্বতঃসিদ্ধ; সাংবিধানিকভাবে সেটাই হয়েছে। কিন্তু হায়, রাষ্ট্রের ভাষা বাংলা হয়নি!

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কি উর্দুবিরোধী ছিল? হ্যাঁ, অবশ্যই। কিন্তু ছিল কি সে ইংরেজিবিরোধী? ‘হ্যাঁ’ সেটাও হওয়ার কথা ছিল বৈকি। কেননা, আন্দোলন ছিল বাঙালি নিজের পায়ে দাঁড়াবে, বাংলা ভাষার মধ্য দিয়ে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ইহজাগতিক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলবে, যেখানে মানুষের পরিচয় ধর্ম, সম্প্রদায় কিংবা অর্থনৈতিক শ্রেণির দ্বারা চিহ্নিত হবে না, পরিচয় হবে ভাষার দ্বারা। কিন্তু রাষ্ট্র গণতন্ত্রের পথে যায়নি। বাংলাদেশে অন্তত একটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে, এই আশাটা ছিল। বৃষ্টিহীন দুপুরের রংধনুর মতোই সে-আশা মিলিয়ে গেছে। আশার স্মৃতিটা এখন পীড়া দেয় তাদের যাদের হৃদয় আছে। বাংলাদেশে সাবেক পাকিস্তানের মতোই একটি আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্র পুনঃস্থাপিত হয়েছে। গণতন্ত্রের মূল কথা যে অধিকার ও সুযোগের সাম্য, জনগণের ন্যূনতম নাগরিক অধিকারগুলোর কার্যকর স্বীকৃতি এবং রাষ্ট্রের বিকেন্দ্রীকরণ ঘটিয়ে সর্বস্তরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা, তার কোনো কিছুই আজ বাংলাদেশে নেই।

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর