শনিবার, ৪ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

চোরাগোপ্তা হামলায় হানাদার বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলি

মোস্তফা মহসীন মন্টু

চোরাগোপ্তা হামলায় হানাদার বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলি

তখন আমার বয়স ২৫। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে এমএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। মাতৃভূমিকে ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত করতে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে রাজপথে আন্দোলন করেছি। তবে এর সূচনা করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আরও আগে। বঙ্গবন্ধু ছয় দফার আন্দোলনকে ধীরে ধীরে এক দফা বা স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত করেছেন। ছাত্র-শ্রমিক-পেশাজীবীসহ এ দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। ফলে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে বিজয়ী হয়।

নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ঠেকাতে না পেরে পাকিস্তানি শাসকরা ষড়যন্ত্র শুরু করে। এদিকে ১৯৭০ সালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদের এক মিছিলে বাধা দিলে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বেঁধে যায় ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একটি মিছিলের সঙ্গে এ সংঘর্ষে পাকিস্তানের একজন ক্যাপ্টেন নিহত হন। এ ঘটনায় আমি, ছাত্রনেতা কামরুল আলম খান খসরু এবং আমার ভাই সেলিম জাহানসহ ৪০০ জনকে আসামি করে মামলা দেওয়া হয়। একই বছরের জুনে ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) থেকে আমি গ্রেফতার হই। দীর্ঘ ৯ মাস কারাভোগের পর একাত্তরের ১ মার্চ আমরা জেল ভেঙে বের হই। একই দিন ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদ সভা স্থগিত ঘোষণা করেন। এ ঘোষণার পর সারা বাংলার মানুষ গর্জে ওঠে। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সমাবেশে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। ডাকসু ভিপি হিসেবে সেদিন রব ভাইয়ের (আ স ম আবদুর রব) হাতে পতাকা প্রদর্শনের দায়িত্ব পড়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ৩ মার্চ থেকে আমরা অস্ত্র সংগ্রহ শুরু করি। এদিনই পল্টন ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে গুলি ছুড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। জাতীয় সংগীত, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ ও বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। এদিনই শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, কামরুল আলম খান খসরু, আমি এবং ছাত্রলীগের কয়েকজনকে বঙ্গবন্ধু ডেকে বলেছিলেন, পরিস্থিতি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দিকে যাচ্ছে। এরপর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং গেরিলা যুদ্ধের দিকনির্দেশনা দেন। ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়ে যুদ্ধের সময় কী করতে হবে তারও দিকনির্দেশনা দেন। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণের পর পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধের বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। ঘটনা বুঝতে পেরেই ইয়াহিয়া খান আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করতে থাকেন। তারা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করতে থাকেন। ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে সব অফিস আদালতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এদিন মিছিলসহ আমরা ধানমন্ডি-৩২ নম্বর গিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাতে পতাকা তুলে দিয়েছিলাম। ২৫ মার্চ রাত ৯টায় ধানমন্ডি-৩২ নম্বর বাড়িতে আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে ছিলাম। বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন, তোমরা নিরাপদ স্থানে চলে যাও। আমরা বললাম, আপনিও আমাদের সঙ্গে চলুন। বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি চলে গেলে সবাইকে মেরে ফেলবে, তোমরা যাও। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে বের হয়ে আমি ইকবাল হলে আসি, সেখানে কিছু অস্ত্র ছিল, দুটি গাড়িতে সেগুলো তুলি। রাত ১১টায় এসএম হলের সামনে ট্যাংকসহ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অবস্থান নিয়েছে জানতে পেরে আমি গাড়ি নিয়ে আজিমপুর দিয়ে হাজারীবাগ হয়ে কামরাঙ্গীরচর চলে আসি। এরপর নৌকা নিয়ে অস্ত্রসহ কেরানীগঞ্জে পৌঁছে যাই। ২৫ মার্চ দিবাগত রাত দেড়টায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় অতর্কিত হামলা করে গণহত্যা শুরু করে, শহরের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ করে। ২৬ মার্চ কেরানীগঞ্জে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি। এদিন লাখ লাখ মানুষ ঢাকা থেকে পালিয়ে কেরানীগঞ্জের দিকে আসতে থাকে। ঢাকা থেকে শেখ ফজলুল হক মণি, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, আবদুল মালেক উকিল, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী কেরানীগঞ্জে আসেন। তারপর আমাদের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা ফরিদপুর হয়ে মুজিবনগরে চলে যান। পরে সেখানে অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। এ সরকারের তত্ত্বাবধানেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জে আসা পলায়নপর মানুষের খাদ্য ও আশ্রয় এবং ফরিদপুর হয়ে ভারত বা অন্যত্র যাওয়ার ব্যবস্থা করি। পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করি। এ সময় আমরা কেরানীগঞ্জ থানা ঘেরাও করে যুদ্ধের জন্য অস্ত্র এবং গোলাবারুদ সংগ্রহ করি। থানার বাঙালি পুলিশদের সঙ্গে নিয়ে আসি। ২ এপ্রিল ফজরের আজানের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কেরানীগঞ্জে হামলা চালায়। ভোর থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত চলা অপারেশনে স্থানীয় ও ঢাকা থেকে এসে আশ্রিত প্রায় সাড়ে ৪ হাজার নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে। এর কয়েক দিন পরে আমি মুজিবনগরে চলে যাই। সেখানে ভবেরপাড়া আমবাগিচা ক্যাম্পের দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়। মণি ভাই ও সিরাজ ভাইয়ের নির্দেশে আমি সারা দেশ থেকে বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে আসা ছাত্রলীগ নেতাদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণের জন্য দেরাদুন ও জাফলং পাঠানোর ব্যবস্থা করি। পরে আমাকে কলকাতা ও শিলিগুড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। দেরাদুনে দুই মাস প্রশিক্ষণ নিয়ে আমি আবার কেরানীগঞ্জে ফিরে এসে গড়ে তুলি ১২টি মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। পরে আমি কেরানীগঞ্জসহ ঢাকা দক্ষিণে ও কামরুল আলম খান খসরু আড়াইহাজারসহ ঢাকার উত্তরে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করি।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, গণফোরাম নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর