মঙ্গলবার, ১৪ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

মহাসড়কে গলার কাঁটা ম্যানুয়াল টোল

টোল প্লাজা ঘিরে যানজট। টোলবুথ আংশিক ডিজিটাল হলেও ম্যানুয়াল যানবাহন। ১০ বছরেও আরএফআইডি ট্যাগ লাগেনি অধিকাংশ গাড়িতে। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। রাজস্ব ফাঁকির আশঙ্কা

শামীম আহমেদ, জয়শ্রী ভাদুড়ী ও হাসান ইমন

মহাসড়কে গলার কাঁটা ম্যানুয়াল টোল

যোগাযোগব্যবস্থায় গতি আনতে সরকার এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, মহাসড়কগুলোর লেন বৃদ্ধিসহ নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চললেও কমছে না ভোগান্তি। গুরুত্বপূর্ণ অনেক মহাসড়কের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ম্যানুয়াল (হস্তচালিত) টোল প্লাজা। ধীরগতিতে টোল আদায়ের কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা বাইপাসের মতো ব্যস্ত মহাসড়কে সব সময় যানজট লেগেই থাকছে। ৬-৭ মিনিটে ১০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে আসা যানবাহনকে শুধু টোল প্লাজা পার হতেই কখনো লেগে যাচ্ছে দুই-তিন ঘণ্টা। এতে মহাসড়কে চলাচলকারীদের ভোগান্তির পাশাপাশি বাড়ছে পণ্য পরিবহনের সময় ও খরচ। একই সঙ্গে হাতে টোল আদায়ের কারণে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব খোয়া যাচ্ছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুরোপুরি অটোমেশন হলে একটি যানবাহন থেকে মাত্র ২-৩ সেকেন্ডে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টোল আদায় হবে। টোল প্লাজায় গাড়ি দাঁড়ানোরই দরকার পড়বে না। প্রতি গাড়ির সামনে থাকবে আরএফআইডি (রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন) ট্যাগ, যাতে গাড়ির নম্বরসহ সব তথ্য থাকবে। আরএফআইডি নম্বরটি সংযুক্ত থাকবে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে অথবা এ আইডিতে অগ্রিম টাকা রিচার্জ করতে হবে। টোলবুথে থাকবে আরএফআইডি রিডার। যানবাহন যতবার সেতুতে উঠে ইটিসি (ইলেকট্রনিকস টোল কালেকশন) বুথ দিয়ে যাবে, ততবার বেঁধে দেওয়া টোলের টাকা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেটে নেবে। তবে বর্তমানে দেশের কোনো সেতুর টোল প্লাজাতেই পুরোপুরি অটোমেশন পদ্ধতিতে টোল আদায় হয় না। একটি যানবাহন থেকে টোল নিতে সর্বনিম্ন ১০ থেকে ৩০ সেকেন্ড লাগছে। ভাংতি টাকার সমস্যা হলে লাগছে ২-৩ মিনিট। ফলে সড়কে গাড়ির চাপ বেশি থাকলেই সৃষ্টি হচ্ছে ১০-১২ কিলোমিটারের ভয়াবহ যানজট। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে টোল আদায়ে কিছু টোল প্লাজার নির্দিষ্ট সংখ্যক বুথ ডিজিটালাইজড করা হলেও সেগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে না।

জানা গেছে, পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু সেতু, মেঘনা সেতু ও গোমতী সেতুর টোল প্লাজায় আংশিক অটোমেশন ব্যবস্থা চালু থাকলেও হাতেই আদায় হচ্ছে টোল। যানবাহনের চাপ কম থাকায় এখন পদ্মা সেতু ও বঙ্গবন্ধু সেতু টোল প্লাজায় যানজট তেমন না থাকলেও ধর্মীয় উৎসব ঈদসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানের দিনগুলোতে পরিবহনের চাপ বাড়লেই সৃষ্টি হয় ভয়াবহ যানজট। অন্যদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গলার কাঁটা হয়ে থাকা মেঘনা ও মেঘনা-গোমতী টোল প্লাজার দুই পাশে অধিকাংশ সময় যানজট লেগেই থাকে। একই চিত্র নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর নির্মিত কাঞ্চন সেতুর টোল প্লাজায়ও। চট্টগ্রাম বন্দর ও সিলেটের সঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চলের সরাসরি সংযোগ স্থাপনকারী সেতুটির টোল প্লাজার উভয় পাশে ৮-১০ কিলোমিটারের যানজট সার্বক্ষণিক চিত্র। এদিকে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে আদায়কৃত টোলের বড় একটি অংশ ভাগ-বাটোয়ারা হয় বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। মেঘনা টোল প্লাজার কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফায়ার সার্ভিস ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যানবাহন থেকে টোল নেওয়া হয় না। আর টোলের টাকা লুটপাটে এই সুযোগটিও কাজে লাগানো হয়।

তবে টোল প্লাজায় অটোমেশন চালু না হওয়ার জন্য টোল কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও যানবাহন মালিকরা একে অন্যের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন। সেতুগুলোর টোল কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের আরএফআইডি রিডার আছে, কিন্তু সব যানবাহনে আরএফআইডি ট্যাগ নেই। কিছু ট্যাগ অস্পষ্ট। আবার ভাংতি টাকার ঝামেলা এড়াতে কিছু টোলবুথে ইটিসি চালু করলেও যানবাহন মালিকরা ইলেকট্রনিকস পদ্ধতিতে টোল দিতে রেজিস্ট্রেশন করে না। বিআরটিএ বলছে, তারা যানবাহন মালিকদের আরএফআইডি ট্যাগ লাগাতে ১০ বছর ধরে বলে এলেও তারা কথা শুনছেন না। অন্যদিকে যানবাহন মালিকরা বলছেন, অনেক যানবাহন মালিক আরএফআইডি ট্যাগের কথা জানেই না। আবার দুর্ঘটনা বা অন্য কোনো কারণে ট্যাগ নষ্ট হলে সেটা পেতে কয়েক মাস ঘুরতে হয়। অনেক টোল প্লাজার আরএফআইডি রিডারও নষ্ট বলে অভিযোগ তাদের।

জানা গেছে, আরএফআইডি ট্যাগ হলো এক ধরনের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির উইন্ডশিল্ড স্টিকার যা মোটরযানের উইন্ডশিল্ডে ভিতরের দিক থেকে সেলফ অ্যাডহেসিভ দ্বারা লাগানো হয়। এর দ্বারা মোটরযানের অবস্থান জানা সম্ভব এবং এক মোটরযানে সংযোজিত ট্যাগ অন্য মোটরযানে ব্যবহার করা যায় না। এ ট্যাগের মধ্যে সংশ্লিষ্ট মোটরযানের রেজিস্ট্রেশন নম্বর, চেসিস নম্বর ও মোটরযানের ধরনসংক্রান্ত কোড থাকে। ট্যাগযুক্ত কোনো মোটরযান কোনো আরএফআইডি স্টেশন অতিক্রমকালে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মোটরযানের অবস্থানসহ যাবতীয় তথ্য দৃশ্যমান হয়। মোটরযানের অবস্থান, গতিবিধি মনিটর, চুরি প্রতিরোধ, মোটরযানের রাজস্ব ফাঁকি প্রতিরোধ, সহজে টোল প্রদানসহ নানা উদ্দেশ্যে ২০১২ সালে মোটরযানে রেট্রো-রিফলেক্টিভ নম্বরপ্লেট ও আরএফআইডি ট্যাগ কার্যক্রম চালু করা হয়। অথচ ২০২৩ সালে এসেও অধিকাংশ যানবাহনে নেই আরএফআইডি ট্যাগ।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মহাসড়কে চলাচল করা সব পরিবহনে আরএফআইডি ট্যাগ লাগানো বাধ্যতামূলক। বিআরটিএর পক্ষ থেকে সবাইকে এই ট্যাগ লাগাতে মেসেজ দিচ্ছি এবং পরিবহনে ট্যাগ লাগাতে আহ্বান জানাচ্ছি। কিন্তু অনেক মালিক সেটা লাগাতে গড়িমসি করছেন। সবাইকে সচেতন করতে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আহ্বান জানানো হচ্ছে। তিনি বলেন, যেসব পরিবহনে আরএফআইডি কার্ড ও ডিজিটাল নম্বরপ্লেট লাগায়নি তাদের বিরুদ্ধে প্রতিটি জেলায় অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

যানবাহনে আরএফআইডি ট্যাগ না লাগানোর ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অটোমেশনে যেতে আমরা প্রস্তুত। অধিকাংশ পরিবহন মালিক আরএফআইডি ট্যাগ লাগিয়েছেন। এর মধ্যে কিছু অংশ কার্যকর আবার কিছু অংশ অকার্যকর। কোনো দুর্ঘটনা হলে বা গ্লাস ভেঙে ট্যাগ নষ্ট হয়ে গেলে নতুন ট্যাগ দিতে বিআরটিএ গড়িমসি করে। মাসকে মাস ঘুরায়। তিনি বলেন, টোল আদায়ে অটোমেশনে যেতে হলে ক্যাম্পেইন দরকার। আরএফআইডি ট্যাগ কেন লাগাতে হবে তা জানাতে হবে। এ ছাড়া পরিবহন মালিকরা আরএফআইডি ট্যাগ লাগালেন কিন্তু টোল সিস্টেম আগের মতোই থাকলে কাজ হবে না। সবাইকে সমন্বয়ের মাধ্যমে উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে হবে।

বিভিন্ন টোল প্লাজার চিত্র- কাঞ্চন সেতু : ঢাকায় প্রবেশের জন্য শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর চারটি সেতু নির্মাণ হলেও বর্তমানে টোল আদায় হচ্ছে শুধু কাঞ্চন সেতুতে। অথচ ২০০৬ সালে সেতুটি উদ্বোধনের সময় ১০ বছর পর্যন্ত টোল আদায়ের কথা বলা হয়েছিল। দিনে এই সেতু হয়ে ঢাকা বাইপাস দিয়ে অন্তত ১৬ থেকে ১৭ হাজার যানবাহন চলাচল করে, যার বড় অংশই পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও পিকআপ। জানা গেছে, ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ওঠানো টোলের টাকার বড় একটি অংশ হিসাবের খাতায় না উঠে একটি প্রভাবশালী চক্রের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হচ্ছে। এ জন্য অটোমেশনে অনাগ্রহ সংশ্লিষ্টদের। যানবাহনের বাড়তি চাপ আর টোল আদায়ে ধীরগতির কারণে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহানা ফেরদৌস বলেন, ১০ বছর পর টোল আদায় হবে না এই কথা ঠিক নয়। সরকারের সিদ্ধান্তেই টোল আদায় করা হচ্ছে। ২০২৫ সালে হাইওয়ে রাস্তার কাজ শেষ হলে এখানে আর টোল থাকবে না। কাঞ্চন সেতুর টোল পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্পের আওতায় তাদের লোকবল দিয়ে আদায় করে তা শতভাগ সরকারি রাজস্ব খাতে জমা হচ্ছে।

মেঘনা মেঘনা-গোমতী সেতু : মেঘনা ও মেঘনা-গোমতী সেতুতে টোল আদায়ে কাজ করছে ইউনাইটেড ডেভেলপমেন্ট কনস্ট্রাকশন (ইউডিসি)। মোট ১০টি টোলবুথ। সাতটিতে উইমস্কেল থাকলেও পাঁচটি সচল। একটি বুথে ইটিসি পদ্ধতি থাকলেও ওই বুথে গাড়ির সংখ্যা খুবই কম। বাকি বুথগুলোয় ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে টোল আদায় হয়। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে টোল আদায়ের কারণে সব সময় যানজট লেগে থাকে। মেঘনা সেতুর টোল ম্যানেজার এস এম জামিল বলেন, তিনটি বুথে আরএফআইডি রিডার লাগানো থাকলেও কাজে আসে না। কারণ অধিকাংশ যানবাহনে বিআরটিএর আরএফআইডি ট্যাগ নেই। যেগুলোর আছে, অধিকাংশ অস্পষ্ট। এ কারণে ম্যানুয়ালি প্রতিটা গাড়ির নম্বর লিখে টোল আদায় হয়। চালকরা ৫০০ বা ১০০০ টাকার নোট দিলে টোলের ভাংতি টাকা দিতে দুই-তিন মিনিটও লেগে যায়। এই সময়ে যানজট সৃষ্টি হয়। যানজট কমাতে বুথ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। একই অবস্থা গোমতী সেতুতেও।

পদ্মা সেতু : পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে টোল আদায়ে সাতটি করে মোট ১৪টি বুথ রয়েছে। সবগুলোতেই ইলেকট্র্রনিকস টোল কালেকশন (ইটিসি) পদ্ধতি রয়েছে। তবে উভয় পাশে একটি করে মোট দুটি বুথে এই পদ্ধতি চালু রয়েছে। বাকি ১২টি বুথ চলছে ম্যানুয়াল সিস্টেমে। ফলে পরিবহনের চাপ বেড়ে গেলে তৈরি হয় যানজট। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌস বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, চালক ও মালিকরা অভ্যস্ত না হওয়ায় সবগুলোতে ইটিসি চালু করা হয়নি। একই সঙ্গে বিআরটিএ এখনো সব পরিবহন ডিজিটাল সিস্টেমের আওতায় আনতে পারেনি। আমরা চালু করলেও পরিবহন মালিক পক্ষ এ পদ্ধতি চালু না করলে লাভ হবে না।

বঙ্গবন্ধু সেতু : উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ১৮-২০ হাজার গাড়ি চলাচল করে। মডার্ন কম্পিউটারাইজ টোল কালেকশন সিস্টেমে টাকা আদায় হলেও কম্পিউটারে গাড়ির নম্বর ইনপুট দিতে হয় হাতেই। টোল আদায়ে গাড়িপ্রতি ৮-১০ সেকেন্ড সময় লাগে। ভাংতি টাকার সমস্যা হলে সময় বেশি লাগে। লেনের তুলনায় গাড়ির চাপ কম থাকায় যানজট তেমন থাকে না। তবে প্রতি ঈদেই টোল প্লাজার দুই পাশে দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধু সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান পাভেল বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে ৯টি করে ১৮টি টোল সিস্টেম রয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করায় টোল আদায়ে কম সময় লাগে। তবে সেতুতে বা সেতুসংলগ্ন মহাসড়কে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তখন যানজট সৃষ্টি হয়। টোল আদায়েও বিঘ্ন ঘটে।

(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি আবদুস সামাদ সায়েম ও রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর আলম হানিফ)।

সর্বশেষ খবর