শুক্রবার, ৭ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন

সব দলের অংশগ্রহণই ইসির চ্যালেঞ্জ

ইভিএমের পক্ষে ছিলেন দুই নির্বাচন কমিশনার, বিপক্ষে সিইসিসহ তিনজন, ব্যালটে ফেরা নিয়ে সিইসির ব্যাখ্যা, বললেন ইসি ব্যালটে ফিরেছে নিজের সিদ্ধান্তে, সংকট দলগুলোকে নিরসন করতে হবে

গোলাম রাব্বানী

সব দলের অংশগ্রহণই ইসির চ্যালেঞ্জ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট করার পরিকল্পনা রাখা হলেও সোমবার কমিশন বৈঠকে সংসদ নির্বাচনে ইভিএম না ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফলে ৩০০ আসনেই ব্যালট পেপারে ভোট হবে। যদিও ওই বৈঠকে ইভিএম ব্যবহার করা নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত ছিল নির্বাচন কমিশন। ইসি সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার থেকে সরে এলেও এখনো ভোটে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে বিএনপি। এমনকি তারা ইসির সংলাপে আসার বিষয়টিও নাকচ করে দিয়েছে। এ অবস্থায় আগামী সংসদ নির্বাচনে সব দলকে ভোটে আনাই নির্বাচন কমিশনের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

সূত্র জানিয়েছে, সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল, নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা ও মো. আলমগীর। অন্যদিকে সচল ইভিএমের সর্বোচ্চ ব্যবহারের পক্ষে ছিলেন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান ও মো. আনিছুর রহমান। ইসির বৈঠকে সংসদ নির্বাচনে সচল ইভিএমের সর্বোচ্চ ব্যবহার করার প্রস্তাব উপস্থাপন করেন নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন ইতিপূর্বে সংসদ ভোটে ইভিএম ব্যবহার করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই অন্তত ৩০-৩৫ আসনে সচল ইভিএম দিয়ে ভোট করা যেতে পারে। কিন্তু সংসদ নির্বাচনে কোনো আসনেই ইভিএম না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। ইভিএম ব্যবহার থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত এখনই না নিয়ে একটু সময় নেওয়া প্রয়োজন। বৈঠকে তার প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করে নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান বলেন, ‘এ পর্যন্ত ৬০০-এর বেশি নির্বাচন ইভিএমে করেছি। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ছাড়াই সুষ্ঠুভাবে সবার প্রত্যাশা অনুযায়ী সাফল্য অর্জন করেছি।’ তাই সচল ইভিএমের সর্বোচ্চ ব্যবহার করার পক্ষে বৈঠকে মতামত দেন তিনি। সূত্র জানিয়েছে, সচল ইভিএম দিয়ে ৩০-৩৫ আসনে ভোট করা সম্ভব বলে বৈঠকে ইভিএম প্রকল্প পরিচালকের কাছে নিশ্চিত হন এই নির্বাচন কমিশনার।

এদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যালটে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। গতকাল নির্বাচন ভবনে এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেছেন, কোনো দলকে ভোটে আনতে বা কারও চাপে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। সিইসি বলেন, ‘এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ভোটে আসতে রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সংকট নিরসন করা। বড় কোনো দল নির্বাচনে না এলে তা লিগ্যালি সিদ্ধ হলেও পুরো লেজিটিমেট হবে না।’ সে জন্য বিএনপিসহ সংলাপ বর্জন করা দলগুলোকে ভোটে আসার আহ্বান জানানো অব্যাহত থাকবে বলে জানান সিইসি।

তিনি বলেন, ‘কাউকে জোর করে ভোটে আনার বিষয়টি কমিশনের নয়। দলগুলোকে ভোটে আসতে শেষ পর্যন্ত আহ্বান অব্যাহত থাকবে। আগাম নির্বাচনের কোনো প্রস্তুতি নেই। এ বছর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে আগামী বছর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রস্তুতি এগিয়ে চলেছে।’ অর্থ সংকটের মধ্যে নতুন ইভিএম কেনার প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প স্থগিত হওয়ার পর হাতে থাকা ইভিএম মেরামতে প্রায় ১৩০০ কোটি টাকার সংস্থানে সরকারের সায় না মেলায় নির্বাচন কমিশন সোমবার ইভিএম থেকে সরে এসে সংসদ নির্বাচনে ব্যালটে ভোট করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর তিন দিনের মাথায় কমিশনের ব্যাখ্যা তুলে ধরতে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন সিইসি। নির্বাচন ভবনে এ ব্রিফিংয়ে চার নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব খান, রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর ও মো. আনিছুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।

এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘ইভিএম থেকে সরে আসা হয়েছে সেদিন। এ নিয়ে নানা সংশয় বাজারে দেখা দিয়েছে। এটা কি চাপে করা হলো। এটা নিয়ে কমিশন দীর্ঘ আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

তিনি বিলেন, ‘কোনো দলের প্রত্যাশা ছিল ৩০০ আসনে ইভিএম। পরে কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সর্বোচ্চ দেড় শ আসনে করবে। ইভিএমের প্রতি ইসির আস্থাটা অনেক বেশি, ইভিএমকে হ্যান্ডল করেছে ইসি, রাজনৈতিক দলগুলো করেনি। প্রায় ১২০০ নির্বাচন হলেও একটিতে অভিযোগ পড়েনি ম্যানিপুলেশন হয়েছে, ম্যালফাংশন হয়েছে কোথাও, মেকানিক্যাল কথা বলা হয়েছে। এখানে ভূত আছে, ভানুমতীর খেল আছে- দশটা ভোট দিলে তিন জায়গায়, সাতটা অন্য জায়গায় যায়- এমন অভিযোগ আসেনি। আমরা বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করেছি, একেবারেই অভিযোগ সত্য নয়। আমাদের বিশ্বাস দিয়ে তো হবে না। এর পরও অনেকের আস্থা নেই। তাতে ছোট সংকট থেকে যায়।’

দেড় শ আসনে ইভিএম ব্যবহার করতে চাইলেও অর্থ সংকটের কথা তুলে ধরে সিইসি বলেন, ‘১২০০ কোটি টাকার প্রস্তাব দেওয়া হয় মেরামতের জন্য। তাতেও সরকার সম্মত হতে পারেনি।’ এমন পরিস্থিতিতে ইভিএম নিয়ে ইসি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে বলে জানান তিনি, ‘আমরা দ্বিধাবিভক্ত হলাম, আলোচনা করলাম গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। দুজন কমিশনার বললেন, ২৫-৩০টা ইভিএমে করে ফেলি। আমরা দেখলাম ইভিএমের লাইফটাও শেষ হয়ে আসবে, সে সময় হয়তো ম্যালফাংশন হলে একটা দোদুল্যমান অবস্থা আমাদের মধ্যে। তখন আমিও যুক্ত হলাম। আমরা ইভিএমে যাব না, আরও দুজন সহকর্মী থাকল। এটা সম্পূর্ণরূপে আমাদের সিদ্ধান্ত। এর বাইরে কোনো চাপে করা হয়েছে কি না বা বিএনপিকে ভোটে আগ্রহী করার জন্য করা হয়েছে- এ ধরনের কোনো চিন্তা-চেতনা আমাদের মধ্যে ছিল না। দ্বিধাবিভক্ত ছিলাম আমরা। দুজন মতামত দিল ইভিএমের মাধ্যমে কিছু হোক। আমরা তিনজন বললাম- এটা অনিশ্চয়তা, এটা সমর্থন করছি না।’

সিইসি বলেন, ‘আমরা সব সময় বিশ্বাস করেছিলাম, ব্যালটের চেয়ে ইভিএমে ভোট অনেক বেশি নিরাপদভাবে করা সম্ভব হয়। এটা যান্ত্রিক কারণে...। শতভাগ সুষ্ঠু ভোট নিশ্চিত করা ইভিএমে যেমন সম্ভব নয়, ব্যালটেও পুরোপুরি সম্ভব নয়। বিষয়টা আপেক্ষিক হতে পারে।’ ইসির কাছে ইভিএম কোনো ‘বড় চ্যালেঞ্জ নয়’ জানিয়ে হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘আমাদের নির্বাচনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, যে রাজনৈতিক সংকটটা বিরাজ করছে, নির্বাচনে সবাই বা প্রধানতম দলগুলো অংশ নেবে কি নেবে না, সেটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। ইভিএমে ভোট করলে পোলিং প্রসেস সহজ হয়।’ ইসি সব দলকেই ভোটে চায় জানিয়ে সিইসি জানান, ‘আমাদের সেই প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। কাউকে জোর করে আমরা আনতে পারছি না। কিন্তু যেটা করার সে আপিল করেই যাচ্ছি। আমাদের ডাকে সাড়া দেবেন তাও নয়। সংকটটা যদি রাজনৈতিক দলগুলোর হয়ে থাকে অথবা সরকারি দলের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের হয়ে থাকে, আমরা বলব সে রাজনৈতিক সংকটগুলো আপনারাই নিরসন করলে নির্বাচনটা সহজ ও ইসির জন্য অনুকূল হয়ে যাবে।’

রাজনৈতিক সংকট সমাধানে ইসির ভূমিকা না রাখার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে ইসি কোনো বড় রোল প্লে করতে পারবে না। এটাই আমাদের বড় রোল- প্লিজ আসুন, আসুন নির্বাচনে। আপনারা নিজেদের মধ্যে সংলাপ করুন, বিরাজমান দূরত্ব ও সংশয়, বিরোধ থাকলে তা মিটিয়ে ফেলুন।... এ কথাই বলেছি, সব দল অংশগ্রহণ করলে গণতান্ত্রিক চেতনা থেকে সে নির্বাচন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য, অনেক প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে।’

সুষ্ঠু ভোট করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে সিইসি বলেন, ‘আমাদের চেষ্টার ত্রুটি থাকবে না। সুষ্ঠু ভোট করার চেষ্টা করব। এটা সত্য, ব্যালটে রিগিং (জালিয়াতি) প্রতিহত করা যতটা কষ্টকর, ইভিএমে মোটেই অতটা কষ্টকর নয়।’

তিনি বলেন, ‘অনেকে বলে থাকেন, ব্যালটে রাতে ভোট হয়ে গেছে। সত্য-মিথ্যা আমি একেবারেই জানি না। কিন্তু পারসেপশন ক্রিয়েট করেছে রাতেও ভোট হতে পারে। ইভিএম কিন্তু সকাল ৮টার আগে চালুই হবে না। এটা সো অটোমেটিক। এখানে ন্যূনতম সম্ভাবনা ছিল না। ওদিক থেকে ইভিএমে বেশ কিছু ইতিবাচক দিক ছিল।’

তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রের নিরাপত্তা সবচেয়ে বেশি ভালো হয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হলে। ধরুন কোনো দল অংশ নিল না, একটা দল অংশ নিল, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হবে সন্দেহ নেই। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো থাকলে কেন্দ্রে ভারসাম্য হয়, যা আর্মি, নেভি, র‌্যাব, পুলিশ করে না। সেখানে ভারসাম্য রক্ষা করতে সনাতন পদ্ধতি হচ্ছে দল থাকবে, এজেন্ট থাকবে। কেন্দ্রের বাইরেরটা আমরা দেখতে পারব। কিন্তু ভিতরেও কারচুপির সুযোগ থাকে। এটা রাজনৈতিক দলগুলো বুঝবে, অংশগ্রহণমূলক ভোটের জন্য তারা আলোচনা করে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি এনে দিলে আমাদের সহায়ক হবে।’ ভোটে সিসি ক্যামেরা ব্যবহারের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান সিইসি।

সর্বশেষ খবর