রবিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

আবার পুড়ল ব্যবসায়ীদের স্বপ্ন

নিজস্ব প্রতিবেদক

আবার পুড়ল ব্যবসায়ীদের স্বপ্ন

চোখের সামনে সব পুড়তে দেখে ব্যবসায়ীর কান্না -রোহেত রাজীব

মাত্র ১১ দিনের ব্যবধানে এবার আগুনে পুড়ল রাজধানীর সব ধরনের পণ্যের অন্যতম ব্যস্ততম নিউমার্কেট। এর আগে পুড়ে ছাই হয়েছে কাপড়ের বৃহত্তম পাইকারি বাজার বঙ্গবাজার।

ঈদের মাত্র সাত দিন বাকি থাকতেই আগুনে পুড়ল নিউ সুপার মার্কেট। ৪ এপ্রিল ভোরে আগুনে সব হারিয়ে বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা এখন চৌকি পেতে পণ্য বিক্রি করছেন। চেষ্টা করছেন ঘুরে দাঁড়ানোর।

গতকাল নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীরা বলছিলেন, ঈদের আগে এমনভাবে আগুন লাগবে, আর তাদের সব শেষ হয়ে যাবে, তা তারা কল্পনাও করেননি। বুঝতেও পারেননি, তাদের অবস্থা বঙ্গবাজারের দোকানিদের মতো হবে। তাদের ধারণা, এই আগুনে শত কোটি টাকার মালামাল পুড়ে গেছে।

গতকাল ভোর ৫টা ৪০ মিনিটে নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। সাড়ে তিন ঘণ্টা পর সকাল ৯টা ১০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে জানায় সংস্থাটি। তবে আগুন পুরোপুরি নেভাতে আরও সময় লাগার কথা জানান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।

তাদের ভাষ্য, কাছাকাছি পানির অন্য কোনো উৎস না থাকায় ঢাকা কলেজের পুকুর থেকে পানি নেওয়া হয়। তারা মনে করেন, ওই পুকুর না থাকলে আগুন নেভাতে আরও বেগ পেতে হতো। ফায়ার সার্ভিসের ৩০টি ইউনিটের সঙ্গে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ, আনসার ও স্বেচ্ছাসেবীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সহায়তা করে।

এর আগে আগুনের সূত্রপাতের পরই সায়েন্সল্যাব মোড় থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে রাখে পুলিশ। বন্ধ করে দেওয়া হয় বাটা সিগন্যাল থেকে নিউমার্কেটে যাওয়ার পথও। মূলত আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের কাজ যেন ব্যাহত না হয়, সে জন্য পথ বন্ধ রাখা হয়েছে। রাস্তার পাশের দু-একজন ব্যবসায়ী দোকান খুললেও অধিকাংশ মার্কেটের দোকানপাট ছিল বন্ধ। এ সময় দূর-দূরান্ত থেকে অনেককে নিউমার্কেটে কেনাকাটা করতে এসে ফিরে যেতে দেখা গেছে।

এদিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে ধোঁয়ায় অসুস্থ ও নানাভাবে আহত হয়েছেন অন্তত ৩২ জন। তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। ঢামেক সূত্র জানায়, আহতরা হলেন- ফায়ার সার্ভিসের সদস্য রাসেল (২২), শান্ত (২৪), তৌফিক (২৩), রাজন (২৫), মিলন (২৬), সজীব (২৫), আরিফুল (২৬), কামরুজ্জামান (২৫), শরিফুল (২৪), সোহেল রানা (৩২), রাজীব (৩০), ডিপজল (২৪) ও রায়হান (২২)। নিউমার্কেটের দোকানকর্মীদের মধ্যে আছেন- রিফাত (২৩), বায়জিদ (২৫), হাসান (২০), রিমন (২৮), কামাল হোসেন (৩৩), ফিরোজ আলম (৩০), জীবন (৩০), জিসান (১৮), ইয়াসিন (২৪), জীবন (২৫), স্বপন (২৩), ফারহান (২০) ও শাফিন (১৮)। এ ছাড়া আহতদের মধ্যে আছেন বিমান বাহিনীর সদস্য সার্জেন্ট আরাফাত (৩২), আনসার সদস্য সবুজ (২০), আলমগীর (৩৫), শাকিল (২৫), রিকশাচালক জাকির হোসেন (৩০) ও স্বেচ্ছাসেবক সাব্বির (৩৩)। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ‘ঈদের আগে কেন মার্কেটে মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আমি অনুরোধ জানাব, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যেন বিষয়টি খতিয়ে দেখে। ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটের অগ্নিকান্ডে ভলান্টিয়ারসহ আমাদের ১২ জন ফায়ার ফাইটার আহত হয়েছেন।’ গতকাল সকালে নিউ সুপার মার্কেট এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, আগুনের খবর পাওয়ার পরই নিচতলার দোকানিরা তাদের মালামাল নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে থাকেন। ওই মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় সময়ের ব্যবধানে আগুন ছড়ায়। তবে দ্বিতীয় তলায় আগুনের মাত্রা ছিল কম। দ্বিতীয় তলায় যাদের দোকান, তারা ঝুঁকি নিয়ে দোকানের ভিতর ঢুকে মালামাল সরিয়ে নিতে থাকেন। দোকান থেকে মালামাল বের করে আনতে সব ধরনের সহযোগিতা করেন সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। ফায়ার সার্ভিসের ক্রেন ব্যবহার করে দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা থেকে মালামাল বের করে আনতে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করেন তারা।

পৌনে ১২টায় মার্কেটের তৃতীয় তলা থেকে আগুনের ধোঁয়ার কু-লী বের হতে দেখা যায়। তখন পুরো নিউমার্কেট এলাকার সব দোকান বন্ধ থাকে। তবে নিজ নিজ দোকানের সামনে অবস্থান করে ছিলেন উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা। নিউ সুপার মার্কেট-সংলগ্ন দক্ষিণের নিউমার্কেটের অনেক দোকান থেকে মালামাল সরিয়ে নিতে দেখা গেছে। এরপর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর ব্যবসায়ীরা মার্কেটের ভিতরে ঢুকে দেখেন আগুনে সব শেষ। যে কাপড়গুলো পোড়েনি সেগুলোও নষ্ট হয়েছে পানিতে ভিজে। দুপুরের পরও ওই মার্কেট থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা গেছে। আর ব্যবসায়ীরা নিজ নিজ দোকানে ঢুকে কাগজপত্র, টাকা-পয়সা যা পান বস্তায় ভরে বের করতে থাকেন।

আগুন লাগার পরপরই ঢাকা কলেজের মূল ফটক এবং টিচার্স কোয়ার্টার-সংলগ্ন গেট খুলে দেওয়া হয়। এ দুটি গেট দিয়েই পুকুর থেকে পাইপের মাধ্যমে পানি নিয়ে আগুন নেভানোর কাজ করে ফায়ার সার্ভিস। এ ছাড়া ঢাকা কলেজের দক্ষিণ দিকের প্রাচীরের কিছু অংশ ভেঙে দেওয়া হয়। সেসব অংশ দিয়ে পানি নেওয়া হয়। সকাল থেকে আগুন নিয়ন্ত্রণকাজে ফায়ার সার্ভিসকে সহায়তা করেন ঢাকা কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

মাহাবুব নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমাদের যা ক্ষতি হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এখন ঘুরে দেখছি কোনো কূলকিনারা পাওয়া যায় কি না। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আমার পাইকারি দোকানে ২০ লাখেরও বেশি টাকার কাপড় ওঠানো ছিল। আজকে হোলসেল ডেলিভারি দেওয়ার জন্য অনেকগুলো প্যাকেট কমপ্লিট করে দোকানে রেখে রাতে বাসায় গিয়েছিলাম। সকালে এসে দেখলাম সব শেষ। এখন কীভাবে ঘুরে দাঁড়াব সেটি বুঝতে পারছি না।’ আসমাউল মুত্তাকিন নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমার দোকানে শীতের জ্যাকেট ও তুলার তৈরি গরম কাপড় রাখা ছিল। আগুনে না পুড়লেও পানির ছাঁটে নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এর পরও কর্মচারীদের সঙ্গে নিয়ে সবগুলো বের করার চেষ্টা করছি।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করে। আমরা খেয়াল রাখি, যেন কোনো দুষ্কৃতকারী এ জায়গায় কোনো ধরনের ঝামেলা তৈরি করতে না পারে।’

এদিকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত মার্কেট খোলা হবে না বলে জানিয়েছেন নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ডা. দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন। তিনি বলেন, ‘নিউমার্কেটের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি আমরা প্রাধান্য দিচ্ছি। সব দোকান মালিককে নিয়ে এ জায়গায় অবস্থান করছি। যতক্ষণ পর্যন্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা পর্যাপ্ত না হবে, অর্থাৎ সম্পূর্ণভাবে আগুন না নিভবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মার্কেট খোলা হবে না। এটি সবার সঙ্গে বসেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত আমার কাছে তথ্য হলো, দুই থেকে আড়াই শ দোকান সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া আরও কিছু ক্ষতির শিকার হয়েছে। আগুনের কারণে মার্কেটগুলো সাময়িক বন্ধ আছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে খুলে দেওয়া হবে।’ দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক সাংবাদিকদের বলেন, ‘সাম্প্রতিক আগুনের ঘটনাগুলোতে কোনো নাশকতা রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হবে। আপনারা জানেন আমাদের মার্কেটগুলো যেভাবে তৈরি করা, এর মধ্যে ফায়ার ব্রিগেড বলেছে অনেকগুলো ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট। এ রকম বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে যে কোনো ছোট্ট দুর্ঘটনায় ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটতে পারে। আমাদের পুলিশের পক্ষ থেকে আমরা সবগুলো বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত করব। এগুলো নিছক দুর্ঘটনা, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে।’ তিনি বলেন, ‘এর আগে দুইটা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এরপর আমাদের বঙ্গবাজারে একটি বড় আগুনের ঘটনা ঘটল। শুক্রবার রাতেও হাজারীবাগের একটি ট্যানারিতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। বিস্ফোরণের দুইটা ঘটনাতেই আমরা মামলা নিয়েছি। বঙ্গবাজারে আগুনের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আর আমরা ইন্টারনাল একটা তদন্ত করেছি। যদিও তদন্ত কমিটি করা হয়নি। আমাদের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিস্ফোরণের দুটি ঘটনা প্রাকৃতিক গ্যাস জমার কারণে অ্যাকসিডেন্ট। কারণ আমাদের তদন্তে আমরা এখন পর্যন্ত কোনো নাশকতার আলামত খুঁজে পাইনি। আর দুটি আগুনের ঘটনায় ফায়ার ব্রিগেড তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্ত প্রতিবেদন দেখলে বুঝতে পারব এগুলো নাশকতা, না দুর্ঘটনা।’ খন্দকার গোলাম ফারুক জানান, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীর বিপণিবিতানগুলোতে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হবে।

 

 

সর্বশেষ খবর