শনিবার, ১৩ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

তীব্র গরমে হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর ভিড়

♦ হিট স্ট্রোকে মারা যাচ্ছে মানুষ ♦ মাম্পস আক্রান্ত বাড়ছে ♦ ঝুঁকি বাড়াচ্ছে ডায়রিয়া

নিজস্ব প্রতিবেদক

তীব্র গরমে হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর ভিড়

সুনামগঞ্জের ছাতকে দুপুরে প্রচণ্ড রোদের মধ্যে জমিতে কাজ করছিলেন মনজুর রহমান (৪০)। অসুস্থ হয়ে পড়লে স্বজনরা তাকে পাশের কৈতক হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান তিনি মারা গেছেন। গত বুধবার শান্তিগঞ্জ উপজেলার রাফিয়া বেগম (৬০) এবং দোয়ারাবাজারের আজির উদ্দিন (৬৫) প্রচণ্ড গরমে হিট স্ট্রোক করে মারা গেছেন বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের চিকিৎসক। ওই দিন সুনামগঞ্জে তীব্র গরমে স্কুলের শিক্ষার্থী, কৃষকসহ প্রায় ১৫ জন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে সেবা নিয়েছেন। তীব্র গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছে মানুষ। অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন হিট স্ট্রোকে। গত বৃহস্পতিবার ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় শফিউল আলম নামে এক আইনজীবীর মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসক জানান, অতিরিক্ত গরমে হিট স্ট্রোকে তিনি মারা গেছেন। এ ছাড়া ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর ভিড়। গরমে ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে মাম্পস। শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে জ্বর, হাম, জলবসন্তে। এ ব্যাপারে ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রচণ্ড রোদে অপ্রয়োজনে বাইরে কেউ বের হবেন না। শ্রমিক, দোকানদার, রিকশাচালকসহ যারা বাইরে কাজ করেন, তাদের অবশ্যই ছাতা ব্যবহার করতে হবে। কাজের ফাঁকে এক-দুই ঘণ্টা পর পর ১০-১৫ মিনিটের জন্য ছায়াযুক্ত স্থানে বসবেন। একটু পর পর পানি খাবেন। ডিহাইড্রেশন যাতে না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ঢিলেঢালা কাপড় পরতে হবে। জিন্স না পরাই ভালো। বয়স্ক এবং যারা ডায়াবেটিস, কিডনিসহ বিভিন্ন ক্রনিক রোগে ভোগেন, তাদের জন্য ঝুঁকিটা বেশি। তারা অপ্রয়োজনে বাইরে যাবেন না।’ হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে করণীয় বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কেউ যদি হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয় তাহলে তাকে যত দ্রুত সম্ভব ছায়াযুক্ত স্থানে নিতে হবে। ঘরে থাকলে ফ্যান ও এসি চালু করে তাকে ঠান্ডা স্থানে রাখতে হবে।

ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে দিতে হবে। বেশি বেশি পানি, ফলের জুস পান করাতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তির প্রেশার কমে যাওয়া, প্রস্রাব বন্ধ, পালস কমে যাওয়া বা অজ্ঞান হয়ে গেলে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।’ গরমের মাত্রা বাড়লে যেসব ভাইরাস দ্রুত সক্রিয় হয়ে ওঠে মাম্পস তার একটি। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি, সর্দি, মুখের লালা, প্রস্রাবের মাধ্যমে ছড়ায় ছোঁয়াচে এই রোগ। সঠিক চিকিৎসা না পেলে মস্তিষ্কে প্রদাহ ও কানে কম শোনার সমস্যা হতে পারে। রাজধানীর কলাবাগানের বাসিন্দা নাসরিন আক্তার বলেন, ‘এক সপ্তাহ আগে আমার কানের নিচে জায়গা ফুলে ওঠে এবং তীব্র ব্যথা শুরু হয়। পরদিন থেকে আমার ছয় বছর বয়সী ছেলেও আক্রান্ত হয়। চিকিৎসকের কাছে গেলে জানান আমাদের মাম্পস হয়েছে। গলায় তীব্র ব্যথা, কিছুই খেতে পারছি না। শরীরে বেশ জ্বর।’ শুধু এই মা-ছেলেই নয় অনেকেই হাসপাতালে আসছেন মাম্পস রোগ নিয়ে। সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে মাম্পস রোগীদের জন্য থাকা ৮ শয্যার ছয়টিই পূর্ণ। চিকিৎসকরা বলছেন, প্যারামিক্সো ভাইরাস শ্রেণির অন্তর্গত মাম্পস ভাইরাসের সংক্রমণে মাম্পস রোগ হয়। কানের নিচের প্যারোটিড নামক লালাগ্রন্থিতে সংক্রমণের ১৮-২১ দিনের মধ্যে সাধারণত উপসর্গ দেখা যায়। তবে আক্রান্ত ব্যক্তি বিশেষ করে বড়দের প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের কোনো উপসর্গ থাকে না বা খুব মৃদু উপসর্গ যেমন-জ্বর, গায়ে ব্যথা এবং খাবারে অরুচিজনিত সমস্যা হয়ে থাকে। ছোঁয়াচে বলে এ রোগ হলে আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। রোগীকে আলো-বাতাসপূর্ণ নির্দিষ্ট একটা ঘরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে রাখা, নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করা ও সাত দিন স্কুল বা অফিস যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এ ছাড়া হাঁচি-কাশির সময় নাক মুখ ঢেকে রাখতে হবে। ঢাকা, আশপাশের এলাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য জায়গায় ডায়রিয়া রোগী বাড়ছে। গরমে তৃষ্ণায় দূষিত পানি করে ডায়রিয়া, জন্ডিস, হেপাটাইটিস রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। ফুটপাতে, রাস্তার ধারে আখের রস, লেবুর শরবতে মেশানো নোংরা পানি ডেকে আনছে বিপদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশনের প্রধান অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এই গরমে অতিরিক্ত ঘাম থেকে ডিহাইড্রেশন দেখা দিতে পারে। তাই রোদ এড়িয়ে চলতে হবে। তাছাড়া শরীরে যদি বেশি ঘাম ঝরে, তাহলে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার স্যালাইন গ্রহণ করা প্রয়োজন। তবে পানি আর পানীয়র ব্যাপারে সাবধান।’ তিনি আরও বলেন, ‘বেশি পানি আর পানীয় খেতে গিয়ে আবার না হেপাটাইটিস এ আর হেপাটাইটিস ই ভাইরাস সংক্রমণ থেকে জন্ডিস কিংবা ডাইরিয়া-কলেরা দেখা দেয়। কারণ এই রোগগুলোর তো ছড়ানোর রাস্তা একটাই আর তা হলো দূষিত পানি আর দূষিত খাবার। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম জানান, চট্টগ্রামেও বাড়ছে ডায়রিয়া রোগী। প্রতিদিনই সরকারি তিন হাসপাতালে অন্তত ২০০ নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছে। এর মধ্যে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ রোগীর শরীরে পাওয়া যাচ্ছে কলেরার জীবাণু। এরই মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে একটি বিশেষজ্ঞ টিম ডায়রিয়ার কারণ অনুসন্ধানে চট্টগ্রাম নগরের নির্দিষ্ট কিছু এলাকা ও সরকারি হাসপাতাল পরিদর্শন করেছেন। বিআইটিআইডি ট্রপিক্যাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মামুনুর রশিদ বলেন, আগে ডায়রিয়া রোগীর মধ্যে ২০-২৫ শতাংশ কলেরার রোগী পাওয়া যেত। গত তিন সপ্তাহ ধরে পাওয়া যাচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশের শরীরে। তবে কোনো রোগী আশঙ্কাজনক হচ্ছে না। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরছেন।

সর্বশেষ খবর