রবিবার, ১৪ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

গাছ কেটে পরিবেশের সর্বনাশ

♦ ধানমন্ডিতে ৫৬৩ গাছ কেটেছে ডিএসসিসি ♦ ঢাকায় কমছে সবুজায়ন বাড়ছে তাপমাত্রা ♦ ২৫-এর মধ্যে আছে মাত্র ৮ শতাংশ সবুজায়ন

হাসান ইমন

গাছ কেটে পরিবেশের সর্বনাশ

রাজধানীর ধানমন্ডিতে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ৫৬৩টি গাছ কেটে ফেলেছে। এখনো কাটার অপেক্ষায় রয়েছে ৩৭টি গাছ। শুধু ডিএসসিসি নয়, এর বাইরে সম্প্রতি উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে আজিমপুর কলোনি, মোহাম্মদপুর সরকারি কোয়ার্টার, কল্যাণপুর সরকারি কোয়ার্টার, মিরপুর-৬ সরকারি অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ প্রকল্প, আগারগাঁও সড়ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ওসমানী উদ্যান, সাতমসজিদ রোড, ফার্মগেটের আনোয়ার পার্ক, মেট্রোরেলের আশপাশের সড়ক, উত্তরা ও শ্যামলী পার্কের অনেক গাছ কেটে ফেলেছে বিভিন্ন সংস্থা। এসব গাছ কাটার ফলে নগরীতে কমছে সবুজায়ন, বাড়ছে তাপমাত্রা। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটি নগরীর ২৫ শতাংশ এলাকা সবুজে আচ্ছাদিত থাকার কথা। কিন্তু ঢাকায় রয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ। উন্নয়নের নামে সেই ৮ শতাংশেও করাত চালাচ্ছেন রক্ষকরা। পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য এসব গাছ কাটা ভয়ংকর বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সবুজ ধ্বংসের ফলে বহুমাত্রিক ক্ষতি হচ্ছে। গাছ কমে যাওয়ার ফলে বায়ুদূষণ বেড়ে যাচ্ছে। বাড়াচ্ছে হিট। গাছের সঙ্গে বৃষ্টিপাতের সম্পর্ক রয়েছে। যেখানে সবুজ থাকে, সেখানে বায়োডাইভারসি থাকে। অর্থাৎ গাছপালা থাকলে সেখানে পাখির আনাগোনা থাকে। কাজেই সবুজ ধ্বংসের ফলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যেও প্রভাব পড়ছে। মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কাজেই সবুজ ধ্বংস করে উন্নয়ন সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ২০১৯ সালে স্যাটেলাইট জরিপের মাধ্যমে দেখিয়েছিলাম, ঢাকায় মাত্র ৮ শতাংশ সবুজ এলাকা আছে। এখন ঢাকার কেন্দ্রীয় অঞ্চলে সবুজায়ন ৭ শতাংশের বেশি হবে না। দিন দিন কমছে সবুজায়নের পরিমাণ। অথচ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নগরে ২৫ শতাংশ সবুজায়ন থাকার কথা।’ সরেজমিন দেখা গেছে, ধানমন্ডি সাতমসজিদ রোড শঙ্কর থেকে জিগাতলা পর্যন্ত ২ কিলোমিটার সড়কের মাঝে থাকা গাছগুলো কেটে ফেলেছে রক্ষাকারী সংস্থা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে কিছু অংশ জানুয়ারিতে কেটে ফেলা হয়েছে। আর বাকিটুকু গত সোমবার রাত থেকে কাটা শুরু হয়েছে। এ ২ কিলোমিটার অংশে ৬ শতাধিক গাছ ছিল। মিডিয়ামের সৌন্দর্যবর্ধনের নামে ইতোমধ্যে ৫৬৩টি গাছ কেটে ফেলেছে সংস্থাটি। এর মধ্যে বট, বরই, বকুল, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, শিরিষ, জারুল, নিম, কাঠবাদাম গাছ ছিল। এসব গাছ কেটে সড়কের মিডিয়াম আরও ছোট করে রাখা হয়েছে। যেখানে বড় জাতের গাছ লাগানো যাবে না। শুধু ছোট জাতের গাছ, যেমন ফুলগাছ লাগানো যাবে। এর বাইরে আর কোনো গাছ লাগানো যাবে না বলে পরিবেশবিদরা মনে করছেন। দীর্ঘদিন থেকে এসব গাছ রক্ষায় আন্দোলন করে আসছে গাছ রক্ষা আন্দোলন কমিটি।

এ বিষয়ে গাছ রক্ষা আন্দোলন কমিটির সমন্বয়ক আমিরুল রাজীব বলেন, আমি ধানমন্ডি এলাকায় ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করে আসছি। ওই সময় থেকে এসব গাছ দেখে আসছি। বিভিন্ন সময় আমরাও এখানে গাছ লাগিয়েছি। অথচ সৌন্দর্যবর্ধনের নামে সিটি করপোরেশন গাছগুলো কেটে ফেলেছে। যদিও মেয়র বলেছেন, এখানে গাছ লাগানো হবে। কিন্তু যেসব গাছ কাটা হয়েছে, সেগুলো লাগানোর মতো সড়ক মিডিয়ামে এখন জায়গা নেই। এখন শুধু ফুলগাছ লাগাতে পারে। এর বাইরে আর কোনো গাছ লাগাতে পারবে না। তিনি আরও বলেন, আর ফুলগাছ লাগালেও শীতকালে শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় এগুলো মারা যাবে। কারণ সিটি করপোরেশন কখনো সড়ক মিডিয়ামের গাছগুলোতে পানি দেয় না। সুতরাং আমরা বলতে চাই, উন্নয়ন হোক, কিন্তু পরিবেশ ধ্বংস করে নয়। ঢাকায় উন্নয়ন কাজ করে বেশ কয়েকটি সংস্থা। প্রত্যেকের নিজ নিজ উন্নয়ন পরিকল্পনায় শুধুই অবকাঠামো উন্নয়ন। কোনো সংস্থার ভাবনাতেই সবুজায়নের বিষয়টি নেই। ঢাকার অধিকাংশ মাঠ ও পার্ক সিটি করপোরেশনের অধীনে। এসব মাঠ ও পার্কে উন্নয়নের নামে কংক্রিটের ঢালাই পড়েছে। ফলে হারাচ্ছে সবুজ এলাকা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন ২০১৬ সালে ‘জল সবুজের কাব্যে’ প্রকল্পের অধীনে ৭০টি স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান থেকে প্রস্তাব নেন। প্রকল্পের লক্ষ্যে ছিল ঢাকা দক্ষিণের ৩১টি মুক্ত উদ্যানকে সংস্কার করে উদ্যান, খেলার মাঠ, হাঁটার জায়গা, জিম ও কফি শপ করা হবে। সেখানে কোথাও সবুজায়নের পরিকল্পনা ছিল না। একই সময়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক ‘সবুজ ঢাকা’ গড়তে চেয়েছিলেন। ২০১৫ সালে মেয়র নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১৬ সালের মে মাসে তিনি ‘সবুজ ঢাকা’ প্রকল্প উদ্বোধন করেন। অনেকটা ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে উদ্যোগটি নিয়েছিলেন আনিসুল হক। তিন বছরে উত্তর সিটি এলাকায় ৫ লাখ গাছ লাগানোর পরিকল্পনা ছিল তার। আনিসুল হকের উদ্যোগে উত্তরা এলাকায় কয়েক হাজার গাছও লাগানো হয়। তার মৃত্যুর পর সে প্রক্রিয়ায় ভাটা পড়ে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯৯ সালে রাজধানীতে খোলা জায়গা ছিল ১৪ শতাংশ। বর্তমানে তার পরিমাণ মাত্র ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ। রাজধানীতে সবুজে আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ ২০১৯ সালে ৯ দশমিক ২ শতাংশ। ২০ বছরে সবুজ-আচ্ছাদিত এলাকা কমেছে প্রায় ৩৮ শতাংশ। এ বিষয়ে গত বুধবার ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, গাছ কাটা নিয়ে কেউ কেউ মর্মাহত হতেই পারেন, কষ্ট পেতেই পারেন। এটা তাদের আবেগের বিষয়। আসলে উন্নয়ন কাজে অনেক সময় গাছ ফেলে দিতে হয়, কেটে ফেলতে হয়। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। কিন্তু আমরা তখনই করি, যখন নিতান্তই আর কোনো উপায় থাকে না।’

তিনি আরও বলেন, যে গাছগুলোকে ফেলে দিতে হয়েছে বা কেটে ফেলতে হয়েছে, সেই জায়গায় আমরা অবশ্যই অন্য গাছ লাগাব। উন্নয়ন কাজের প্রয়োজনে গাছ কাটতে হলে সেখানে নতুন করে আমরা ৩ গুণ বেশি গাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যদি একটা গাছ অপসারিত হয়, তাহলে সেখানে আমরা ৩টা গাছ লাগানোর লক্ষ্যেই কাজ করছি। ওই সড়ক বিভাজনে আমরা আরও অনেক বেশি গাছ লাগাব। এ ছাড়া আসন্ন বর্ষা মৌসুমে প্রায় ১০ হাজার গাছ লাগাব। সুতরাং এটা আমাদের চলমান প্রক্রিয়া।

সর্বশেষ খবর