ডলার থেকে নিত্যপণ্য, মসজিদ কমিটি থেকে কবরস্থানে লাশ দাফন এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে সিন্ডিকেট নেই। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, শিশুখাদ্য, বেকারি পণ্যের দামও বাড়ানো হচ্ছে সিন্ডিকেট করে। পরিবহন, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ প্রতিটি সেবা খাত চলে গেছে সিন্ডিকেটের কবজায়। মর্গ থেকে লাশ বের করা, লাশ দাফনেও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। বিদেশে কর্মী পাঠাতেও সিন্ডিকেটের কাছে সর্বস্ব হারাচ্ছে মানুষ। হজযাত্রীদেরও প্রতারণার ফাঁদে ফেলে টাকাপয়সা লুটে নিচ্ছে সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকার বারবার হুঁশিয়ারি দিলেও কোনো কাজ হয় না। প্রতিদিনই নিত্যনতুন সিন্ডিকেটের আবির্ভাব ঘটছে। সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হচ্ছে মানুষ। ডলার সিন্ডিকেটে রয়েছে ব্যাংক ও ব্যক্তি। সিন্ডিকেট করে ডলারের দাম বেশি রাখায় একাধিক ব্যাংক ও ব্যাংক কর্মকর্তাকে জরিমানাও করা হয়েছে। এমনকি দায়িত্ব থেকে সরানো হয়েছে। তবু সিন্ডিকেটমুক্ত হয়নি ডলারের বাজার। একইভাবে নিত্যপণ্য পরিবহন, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ প্রায় সব ধরনের সেবা খাতে চলছে সিন্ডিকেটের নৈরাজ্য। বিশ্লেষকরা বলছেন, সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে সবার আগে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। এর জন্য দরকার রাজনৈতিক অঙ্গীকার। তবে এসব সিন্ডিকেটের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে সরকারের নীতিনির্ধারকরাও জড়িত থাকায় তা কখনই ভাঙা সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি এ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে শক্ত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয় না বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মানুষের কল্যাণে কিছু করতে হলে এ সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। বিশেষ করে পরিবহন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নিত্যপণ্যের মতো অতি জরুরি খাতের সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে মানুষকে স্বস্তি দেওয়া সম্ভব নয়। নিত্যপণ্যের বাজারে তো রীতিমতো তাদেরই রাজত্ব চলে। যার ফলে সরকার বেঁধে দেওয়া সত্ত্বেও নির্ধারিত দামে বিক্রি হয় না পণ্য।
কোনোরকম মনিটরিং ও স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা না থাকায় ডলার, চাল, ডাল, ডিম, পিঁয়াজ-রসুন, আলু, দুধ, চিনি, তরিতরকারি, মাছ, মাংসসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। কখনো কখনো দোষী কিংবা দায়ী ব্যক্তিরা চিহ্নিত হলেও তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হয় না। বরং লঘু পাপে গুরু দণ্ড দিয়ে লোকদেখানো শাস্তি দেওয়া হয়। আবার কখনো কখনো অসৎ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে।সম্প্রতি ডিম, আলু ও পিঁয়াজ সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে বিক্রি না করারও ঘোষণা দিয়েছে সিন্ডিকেট। অথচ সরবরাহ ও মজুদের ক্ষেত্রে কোথাও কোনো সংকট নেই। বরং এ সিন্ডিকেট অবৈধ ও অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়াতে মজুদ গড়ে তুলছে। দেশি-বিদেশি সব ধরনের ফলেও বাজারে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করায় খাবার স্যালাইন ও প্যারাসিটামলের চাহিদা বেড়ে যায়। এর সুযোগ নিয়ে অবৈধ মজুদ গড়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন অসৎ ব্যবসায়ীরা। এতে সাধারণ মানুষ অসহনীয় ভোগান্তির শিকার হয়। অবশ্য ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হলে এ সংকট কমে আসে। বিদেশে কর্মী পাঠাতেও সিন্ডিকেটের কাছে সর্বস্ব হারাচ্ছে মানুষ। হজে পাঠানোর নাম করেও মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে টাকাপয়সা লুটে নিচ্ছে সিন্ডিকেট। এমনকি বিভিন্ন এলাকায় মসজিদ কমিটিতে ঢুকতেও সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হচ্ছেন মুসল্লিরা। হজ প্রতারণা, মসজিদ কমিটির লুটপাট নিয়ে সম্প্রতি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়েছে। এমনকি একই মসজিদে সিন্ডিকেট না মিললে পাল্টাপাল্টি কমিটির দেওয়া ঘটনাও ঘটছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর পরিচালনা পর্ষদ গঠন কেন্দ্র করেও গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় দফতরি কিংবা নৈশপ্রহরী নিয়োগের ক্ষেত্রে এ সিন্ডিকেট মোটা অঙ্কের নিয়োগবাণিজ্য করে আসছে বলে জানা গেছে। চলতি মৌসুমে ডেঙ্গুতে ৯০০-এর বেশি মানুষ মারা গেছে। অথচ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো জোরালো পদক্ষেপ নেই। শুধু ফগার মেশিন দিয়ে স্প্রে করেই দায়িত্ব শেষ করছে সিটি করপোরেশন। যদিও মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য শত শত কোটি টাকার বাজেট থাকে প্রতি বছর। বিপুল পরিমাণ এই অর্থ সিন্ডিকেট করে সিটি করপোরেশনের অসৎ কর্মকর্তারা আত্মসাৎ করছেন বছরের পর বছর। অথচ সাধারণ মানুষকে অন্যায়ভাবে জরিমানা করা হয় এডিস মশার লার্ভা পাওয়ার দায়ে।
ব্যাংকের এলসি খোলা, বন্দরের জাহাজ, বাকিদের মধ্যে বণ্টন এসব কিছুতেও সিন্ডিকেটের প্রভাব। কয়েক বছর ধরেই আমদানির ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে এমন পরিবেশ তৈরি হয়েছে এবং কয়েকটি জরুরি পণ্যের মার্কেট শেয়ার এখন কয়েকটি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। আমদানি থেকে খুচরা পর্যায় পর্যন্ত বলয় তৈরি করে নিজেদের শর্তে বাজারে পণ্য দিচ্ছে তারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, একাদশ জাতীয় নির্বাচনে শপথ নেওয়া সংসদ সদস্যদের ১৮২ জনই পেশায় ব্যবসায়ী। মোট সংসদ সদস্যের যা ৬২ ভাগ। বর্তমান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বেও আছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের কাছে ব্যবসা আর মুনাফাই প্রাধান্য পাবে, সেটিই স্বাভাবিক।