বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, বাংলাদেশে আর কোনোদিন কেউ যাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে স্বৈরাচার হয়ে উঠতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য বিএনপি সংবিধানে এমন ব্যবস্থা রাখতে চায়, যাতে কেউ যেন পর পর দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে না পারেন। গতকাল কুমিল্লা ও ফরিদপুর বিভাগের তৃণমূল বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় দেওয়া ভার্চুয়াল বক্তৃতায় তিনি একথা বলেন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে দেশব্যাপী বিএনপির বিভাগ ওয়ারি তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক মতবিনিময় সভার অংশ হিসেবে এ সভার আয়োজন করা হয়। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার পতনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশায় যুক্ত হয়েছে নতুন আশাবাদ। আর পরিবর্তিত হয়েছে ভাষা, এই পরিবর্তিত নতুন ভাষা পড়তে ও বুঝতে হবে আর মানুষের আশাবাদকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। সেটা করতে না পারলে ছিটকে পড়তে হবে। তিনি বলেন, এতদিন শুধু আওয়ামী লীগ ছিল প্রকাশ্য প্রতিপক্ষ। আমরা তাদের আক্রমণের ধরন বুঝতাম ও জানতাম। এখন ওরা ছাড়াও চারদিকে অসংখ্য অদৃশ্য প্রতিপক্ষ, এদের অবস্থান অন্ধকারে, এরা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে এই দৃশ্যমান আর অদৃশ্য প্রতিপক্ষ মোকাবিলায়। বিএনপির রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের পরিকল্পনার কথা বলতে গিয়ে তারেক রহমান গত বছর জুলাইয়ে উপস্থাপিত দলের ৩১ দফা কর্মসূচির মৌলিক বিষয়গুলো তুলে ধরে বলেন, বিএনপি ভবিষ্যতে এদেশে স্বৈরশাসনের কবর রচনা করতে চায়। আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রাখতে চায়। রাষ্ট্র পরিচালনায় সমাজের জ্ঞানী গুণীদের প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে দুই কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে চায়। তরুণ ও বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান, আর কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত যোগ্যতা অনুযায়ী ভাতা প্রবর্তন করতে চায়। নিশ্চিত করতে চায় সর্বস্তরে নারীর অংশ গ্রহণ। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রে আনতে চায় যুগোপযোগী আমূল পরিবর্তন। গড়তে চায় ধর্ম-বর্ণ গোত্র গোষ্ঠী সমতল পাহাড়ি নির্বিশেষে এক সুষম সমঅধিকারের আধুনিক বাংলাদেশ। বিএনপির এই শীর্ষনেতা দলের সব নেতা-কর্মীকে এ বার্তা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর নির্দেশ দেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সফলতা আর জনপ্রিয়তার একমাত্র ভিত্তি ছিল, দেশের সর্বস্তরের মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা। এদেশের মানুষের প্রাণঢালা ভালোবাসা আর আস্থাই বিএনপির একমাত্র শক্তি। জনগণের এই প্রতিষ্ঠিত ভালোবাসাকে যে কোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে। কোনোভাবেই এটা বিনষ্ট করা যাবে না। আর কেউ যদি কোনো অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়, তাহলে সে যত বড়ই হোক দল তাকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দেবে না। বিএনপি পরিবার ঐক্যবদ্ধ থাকলে যে কোনো ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে অতীতের মত আবারও দল হিসাবে সফল হবেন আশাবাদ ব্যক্ত করেন তারেক রহমান।
নতুন বাংলাদেশ গড়ার শপথ : আজকে ২০২৪ সালে যে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছি তার জন্য বিএনপি দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে সংগ্রাম করছে, লড়াই করছে। বিএনপির সবচেয়ে বেশি নেতা-কর্মী গুম হয়ে গেছে, ২ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। ৬০ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র গণতান্ত্রিক সংগ্রামের জন্য। গতকাল দলের ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে এ কথা বলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যই বিএনপির জন্ম। যে কোনো বাধাই আসুক, মুক্তবাজার অর্থনীতিকে প্রতিষ্ঠা করা এবং দেশকে সমৃদ্ধ বাংলাদেশে পরিণত করার জন্য আমরা কাজ করে যাওয়ার জন্য শপথ নিয়েছি।
গতকাল বেলা ১১টায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খানসহ কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে নিয়ে শেরেবাংলা নগরে জিয়ার কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন এবং প্রয়াত নেতার আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করেন। এ সময় দলের ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, আহমেদ আজম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, আবদুস সালাম, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক এমপি জহির উদ্দিন স্বপন, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, আবদুস সালাম আজাদ, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নাসির উদ্দিন অসীম, প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, কেন্দ্রীয় নেতা নাজিমউদ্দিন আলম, মীর সরাফত আলী সপু, মীর নেওয়াজ আলী নেওয়াজ, আবদুল কাদির ভুঁইয়া জুয়েল, শাম্মী আখতার, মাহবুবুল হক নান্নু, হারুনুর রশীদ, সেলিম রেজা হাবিব, কাজী আবুল বাশার, আমিরুজ্জামান শিমুলসহ কেন্দ্রীয় ও মহানগরের নেতারা ছিলেন।
এ ছাড়া ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল আলম নিরব, সদস্যসচিব আমিনুল হক, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্যসচিব তানভীর আহমেদ রবিন, মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস, হেলেন জেরিন খানসহ বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের নেতারা এতে অংশ নেন। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও সারা দেশে দলীয় পতাকা উত্তোলন, আলোচনা সভা, দোয়া ও মোনাজাতসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বিএনপির ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হয়।
এর আগে সকালে রাজধানীর নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়, গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়সহ সারা দেশে উত্তোলন করা হয় দলীয় ও জাতীয় পতাকা। দুপুরে নয়া পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়।
বিএনপি মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেন, আজকে আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছেন, বাংলাদেশকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্য নিজে কাজ করছেন সেই বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য আজকে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি, শপথ নিয়েছি। যে কেনো বালাই আসুক, সব চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠা করা, মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য আমরা কাজ করে যাব, এটা আমাদের শপথ। তিনি বলেন, আমরা আজকে এ দিনটিকে স্মরণ করছি। আল্লাহর অশেষ রহমতে ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে আজকে আমরা এই দিনটিকে মুক্ত স্বাধীন পরিবেশে পালন করতে পারছি। আমরা বিশ্বাস করি, বিএনপি সবসময় নেতৃত্ব দিয়েছে, আগামী দিনে সঠিক রাজনীতি এবং জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা সঠিকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাব। এখন বিএনপির মূল কাজ হচ্ছে, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, যে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই আদর্শগুলোকে বাস্তবায়িত করা। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন তা প্রতিষ্ঠিত করা।
বিএনপির জন্মদিন পালনে চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার মাজারে শ্রদ্ধা জানাতে সকাল থেকেই নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ঢল নামে। রাজধানীর বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মিছিল নিয়ে নেতা-কর্মীরা আসেন। তারা ‘শুভ শুভ জন্মদিন, বিএনপির জন্মদিন’, ‘লও লও লও সালাম, জিয়া তুমি লও সালাম’, এক জিয়া লোকান্তরে লক্ষ জিয়া ঘরে ঘরে’, ‘আজকের এই দিনে জিয়া তোমায় মনে পড়ে’ ইত্যাদি স্লোগানে বিজয় সরণি থেকে চন্দ্রিমা উদ্যান সরব করে রাখেন তারা। নেতা-কর্মীরা নানা রং-বেরঙের ব্যানার নিয়ে আসেন। তাদের অনেকের মাথায় বিএনপির পতাকা সংবলিত ফিতা বাঁধা ছিল। দীর্ঘ বছর পরে এই প্রথম চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়ার সমাধিস্থলে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি দেখা যায়। অতীতে পুলিশি বাধার কারণে নেতা-কর্মীদের মিছিল এবং প্রবেশে ছিল নানা প্রতিবন্ধকতা।
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীদের ‘যূথবদ্ধ শক্তিমঞ্চ’ হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) বিলুপ্ত করে বিএনপির যাত্রা শুরু হয়। এই দলে যুক্ত হয় মশিউর রহমান যাদু মিয়ার ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কাজী জাফর আহমেদের নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ, মাওলানা আবদুল মতিনের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ লেবার পার্টি ও রসরাজ মন্ডলের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ তফসিলি ফেডারেশন।
বন্যায় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি সীমিত : দেশের পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে ভয়াবহ বন্যার কারণে বিএনপি তার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর ঘোষিত কর্মসূচি সীমিত করে এর অর্থ দলের ত্রাণ তহবিলে দিয়েছে। ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে কর্মসূচির মধ্যে ছিল- আলোচনা সভা, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সারা দেশে শোভাযাত্রা, মৎস্য অবমুক্তকরণ এবং বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচি। বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের পক্ষ থেকে পোস্টার ছাপানো হয়। টানা আড়াই বছর স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের নিষেধাজ্ঞায় দলের মুখপত্র দৈনিক দিনকাল বন্ধ থাকার পর গতকাল রবিবার এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিন থেকে পত্রিকাটি আবার প্রকাশিত হয়েছে।
জিয়া থেকে খালেদা : ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চেয়ারম্যান হন। তাঁর মৃত্যুর পর কিছুদিন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। বেগম খালেদা জিয়া দলের দায়িত্বে আসেন ১৯৮৩ সালে। বিএনপির ৪৬ বছরের ইতিহাসে ৪১ বছর ধরে দলের একটানা সাংগঠনিক নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন খালেদা জিয়া।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় পাঁচ বছরের সাজায় বেগম খালেদা জিয়া পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারে যাওয়ার পর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমান।