পানির পাইপ কাঁধে নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় ট্রাক চাপা দেয় সোহানুর জামান নয়ন (২৪) নামে এক ফায়ার সার্ভিস কর্মীকে। বুধবার রাত ৩টা ১৫ মিনিটের দিকে এ ঘটনা ঘটে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে গতকাল সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। সচিবালয়ে আগুন নেভানোর সময় সোহানকে চাপা দেওয়া ট্রাকের চালক ও তার সহকারীকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে ছাত্র-জনতা। জানা গেছে, সোহান রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার আটপনিয়া গ্রামের আক্তারুজ্জামানের ছেলে। তাঁর মূল কর্মস্থল ছিল সিলেটের বিশ্বনাথ ফায়ার স্টেশন। তিনি তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনে সংযুক্ত ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের এক সদস্য বিকল্পভাবে পানির ব্যবস্থা করছিলেন। এ সময় তিনি পাইপ কাঁধে নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। হঠাৎ দ্রুতগামী একটি ট্রাক পেছন থেকে তাকে ধাক্কা দিলে তিনি রাস্তায় পড়ে যান। মাথায় পরা হেলমেটটি সঙ্গে সঙ্গে খুলে যায়। রাস্তায় ছিটকে পড়ে রক্ত। ঘটনার পর গণপূর্ত ভবনের সামনে দিয়ে ট্রাকটি পালিয়ে যাওয়ার সময় এর চালককে আটক করেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা জানান, ট্রাকটি দ্রুতগতিতে পালিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় সামনে গিয়ে ব্যারিকেড দেন তারা। তখন চালক বেলাল হোসেন সুমন ট্রাক থামান। পরে তাকে মোটরসাইকেলে করে এনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে হস্তান্তর করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় উত্তেজিত জনতা চালককে মারতে উদ্যত হন। সেনাসদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
সোহান নিহতের ঘটনায় গতকাল বিকালে রাজধানীর শাহবাগ থানায় মামলা হয়েছে। মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ওই ট্রাকের চালক বেলাল হোসেন সুমন ও হেলপার ফরহাদকে আদালতে পাঠানো হয়। ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার রুহুল আমিন মোল্লা মামলাটি করেন।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. খালিদ মনসুর জানান, সচিবালয়ের আগুন নিয়ন্ত্রণে তেজগাঁও ফায়ার স্টেশনের স্পেশাল টিম আসে। এই টিমের টিম লিডার ছিলেন মো. হুমায়ুন কবির। তাঁর নেতৃত্বে মিনিবাস গাড়ি ও স্পেশাল টিমের আটজন ফায়ার ফাইটার সচিবালয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে আসেন। তাঁদের অপারেশনাল কাজ চলার সময়ে ফায়ার ফাইটার সোহানুর জামান নয়ন ডেলিভারি হোজ নিয়ে সচিবালয়ের মেইন গেটের সামনে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। তখন গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট থেকে কারওয়ান বাজারগামী একটি ট্রাক দ্রুত ও বেপরোয়া গতিতে ফায়ার ফাইটার নয়নকে চাপা দেয়। উপস্থিত লোকজনের সহায়তায় নয়নকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য ঢামেক হাসপাতালে নেওয়া হয়। জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় উপস্থিত ছাত্র-জনতা ঘাতক ট্রাকের চালক বেলাল ও হেলপার ফরহাদকে ট্রাকসহ আটক করে ডিউটিরত থানা পুলিশের হাতে তুলে দেয়।
বুধবার রাত ১টা ৫২ মিনিটে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে অগ্নিকান্ডের খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। প্রথমে সচিবালয়ে অবস্থিত ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটটি রাত ১টা ৫৪ মিনিট থেকে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। এরপর তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় পর্যায়ক্রমে ১৮টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। পরে আরও দুটি ইউনিট বাড়ানো হয়।
কারাগারে চালক-হেলপার : ফায়ার ফাইটার মো. সোয়ানুর জামান নয়নকে ট্রাকচাপা দিয়ে হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার চালক বেলাল হোসেন ওরফে সুমন ও হেলপার মো. ফরহাদকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল তাদের দুজনকে আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর আসামিদের বিরুদ্ধে সড়ক পরিবহন আইনের মামলায় কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক আমিরুল ইসলাম। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মিনহাজুর রহমান তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
ফায়ার ফাইটার নয়নের মৃত্যুর ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের এপি মো. রুহল আমিন মোল্লা বাদী হয়ে সড়ক পরিবহন আইনে গতকাল শাহবাগ থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, বুধবার দিবাগত রাত ২টার দিকে সচিবালয়ের আগুন লাগে। এ সময় খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস থেকে টিম সেখানে যায়। এরপর রাত ৩টা ১০ মিনিটের দিকে সচিবালয়ের মেইন গেটের সামনে রাস্তা পারাপার হওয়ার সময় গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট হতে কাওরান বাজারগামী ট্রাকে আসামিরা দ্রুত ও বেপরোয়া গতিতে চালিয়ে ফায়ার ফাইটার মো. সোয়ানুর জামান নয়নকে চাপা দেয়। এ সময় নয়ন মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর আঘাত প্রাপ্ত হন। পরে তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হলে জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এদিকে, নয়নকে ট্রাকচাপা দেওয়ার পর ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছাত্র ও সাধারণ জনতা ঘাতক ট্রাকের চালক বেলাল হোসেন ওরফে সুমন ও হেলপার মো. ফরহাদকে ট্রাকসহ আটক করে।
নয়নের বাড়িতে শোকের মাতম : ঢাকার সচিবালয়ে লাগা আগুন নেভাতে গিয়ে ট্রাকের চাপায় নিহত ফায়ার সার্ভিস কর্মী সোয়ানুর জামান নয়নের (২৪) রংপুরের মিঠাপুকুরের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। বাবা-মায়ের এক মেয়ে ও এক ছেলে সন্তানের মধ্যে নয়ন ছিল ছোট। সন্তানের মৃত্যু সংবাদ জানার পর থেকে জ্ঞান হারাচ্ছেন মা নার্গিস বেগম। নিহত নয়ন ছিলেন রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বড়বালা ইউনিয়নের ছড়ান আটপনিয়া গ্রামের কৃষক আখতারুজ্জামানের ছেলে। তিনি দুই বছর ধরে ফায়ার সার্ভিসে কর্মরত ছিলেন। মা নয়নের মা নার্গিস বেগম কান্নারত অবস্থায় বলেন, ‘আমার ছেলের ডিগ্রির রেজাল্ট হলে প্রমোশন হতো, তারপর বিয়ে করত। আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। ছেলের প্রমোশন আর হলো না।’ নয়নের ভগ্নিপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, পরিবারের একজন উপার্জনকারী ছিল নয়ন। জমিজমা বিক্রি করে চাকরি নিয়েছিল। তার মৃত্যুতে পরিবারটি নিঃস্ব হয়ে গেল। কয়েক দিন আগে অগ্রণী ব্যাংক থেকে সে ৫ লাখ টাকা ঋণ করেছিল বলেও জানিয়েছেন সাইফুল ইসলাম।
নিহতের স্বজনরা বলছেন, নয়নই ছিল পরিবারের ভরসা। তাকে ঘিরেই স্বপ্ন দেখতেন তার মা-বাবা ও বোন। কিন্তু হঠাৎ এমন মৃত্যুতে পুরো পরিবার নিস্তব্ধ। এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না কেউই। এ ঘটনার দ্রুত বিচার নিশ্চিতের পাশাপাশি অসহায় নয়নের পরিবারের পাশে যেন সরকার দাঁড়ায় সে দাবিও জানান তারা। পরিবারের পক্ষ থেকে লোকজন নয়নের লাশ আনতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেছেন বলে জানিয়েছেন তার স্বজনরা। এরপর রংপুরে নিজ বাড়িতে তার দাফন সম্পন্ন হবে।