দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী শিক্ষাবিদ চিন্তাবিদ প্রাবন্ধিক ও ‘নতুন দিগন্ত’ পত্রিকার সম্পাদক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ৯০তম জন্মদিনে বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত হয়েছে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। গতকাল বিকালে বাংলা একাডেমিতে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ‘নতুন দিগন্ত’ পরিবার।
আলোচনার বিষয় ছিল ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও জাতীয়তাবাদের ভূমিকা’। অনুষ্ঠানের শুরুতে সংগীত পরিবেশন করে বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। আলোচনা শেষে লু স্যুনের গল্প অবলম্বনে নাটক ‘কৃতদাস কথা’ মঞ্চস্থ করা হয়। অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য প্রদান করেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি তাঁর দীর্ঘ বক্তব্যে আধুনিক পুঁজিবাদের সংকট, ব্যক্তি মালিকানার সীমাবদ্ধতা এবং সামাজিক বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, জাতীয়তাবাদ দুই রকমের হতে পারে আগ্রাসি ও আত্মরক্ষামূলক। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল আত্মরক্ষামূলক জাতীয়তাবাদের প্রকাশ, যেখানে একটি নিপীড়িত জাতি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় লড়াই করেছিল। আর আজকের ইসরায়েলি ইহুদি জাতীয়তাবাদ আগ্রাসি সাম্রাজ্যবাদের রূপ নিয়েছে। এর চেয়ে ভয়ংকর জাতীয়তাবাদ হিটলার ও মুসোলিনির কাছেই দেখা গেছে। তিনি বলেন, পুঁজিবাদ সামন্তবাদ থেকে মুক্তি দিয়ে সমাজকে এগিয়ে নিলেও বর্তমানে তা লুণ্ঠন ও দুর্নীতির প্রতীক হয়ে উঠেছে। জ্ঞান ও মানবিকতা পেছনে পড়ে গেছে, মুনাফাই হয়ে উঠেছে মুখ্য।
সভ্যতার ইতিহাসে ব্যক্তি মালিকানা কখনো বাদ যায়নি। পুঁজিবাদ সেই ব্যক্তিগত মালিকানাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেছে, যার ফলে বিশ্বব্যাপী মানুষের ওপর দমন, প্রকৃতির ওপর অত্যাচার এবং গণহত্যার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্প্রতি দেশে ঘটে যাওয়া লামিয়া আক্তারের আত্মহত্যার মর্মান্তিক ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেন, সমাজে নারীরা আজও নিরাপদ নয়। ধর্ষণ, সামাজিক অপমান, বিচারহীনতা। সবকিছু মিলিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
সামাজিক মালিকানাকে জাতির মুক্তির পথ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমান সংকট থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হলো ব্যক্তি মালিকানার অবসান ঘটিয়ে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা। এটি কোনো একক দেশের কাজ নয়; দরকার একটি আন্তর্জাতিক সামাজিক বিপ্লব, যাতে প্রকৃত গণতন্ত্র ও মানবমুক্তি নিশ্চিত করা যায়। আলোচনা সভায় কমিউনিস্ট নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, অধ্যাপক শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, লেখক আবু সাঈদ খান, কবি সাজ্জাদ শরিফ, সমাজকর্মী রাজেকুজ্জামান রতন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক পারভীন হাসান এবং সঞ্চালনা করেন অধ্যাপক আজফার হোসেন।
উল্লেখ্য, ১৯৩৬ সালে বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কৈশোরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও দেশভাগের দুঃসহ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী স্বৈরাচারবিরোধী গণ আন্দোলনসহ নানা পর্যায়ে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। একই সঙ্গে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা, গবেষণা ও সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তার শিক্ষাজীবন শুরু ঢাকার বিক্রমপুরে, পরে রাজশাহী ও কলকাতায়। দেশভাগের পর ঢাকায় ফিরে এসে সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, নটর ডেম কলেজ থেকে আইএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে বিএ অনার্স, এমএ। পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা, লিডস বিশ্ববিদ্যালয় (যুক্তরাজ্য) ১৯৬০; পিএইচডি, লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় (যুক্তরাজ্য) ১৯৬৮। বর্তমানে আমৃত্যু ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১১৬টি।