সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে লাগাতার আন্দোলনের ১১তম দিন ছিল ১১ জুলাই। কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমাতে হার্ডলাইনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা সর্বাত্মক বাংলা ব্লকেড কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাস্তা অবরোধ করতে নামেন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশে দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের প্রথমবারের মতো বাধা দেয় রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনী। দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে পুলিশ বাহিনী। কিন্তু বেশির ভাগ স্থানে হাজারো শিক্ষার্থীর বিক্ষুব্ধ মিছিলের তোড়ে ভেসে যায় পুলিশি বাধা। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে এদিন অন্তত ২৩ জন শিক্ষার্থী আহত হন। সংঘর্ষ হয় ঢাকার আগারগাঁও, চট্টগ্রামের টাইগার পাস ও কুমিল্লায়। কুষ্টিয়াতেও পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। রাজধানীর শাহবাগে বিশাল জমায়েত নিয়ে পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙেন শিক্ষার্থীরা। বিকাল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে সহস্রাধিক শিক্ষার্থীর একটি বিক্ষোভ মিছিল শাহবাগ অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। শাহবাগে মেট্রোস্টেশনের নিচে পুলিশ বাহিনী তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। একপর্যায়ে পুলিশ শিক্ষার্থীদের রাস্তা ছেড়ে দেয়। রাজধানীর সায়েন্সল্যাব মোড় অবরোধ করতে গেলে ঢাকা কলেজ ও ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীদের বাধা দেয় পুলিশ।
বাধা উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শাহবাগে এসে অবস্থান নেন। রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিলে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। এতে আহত হয় অন্তত ১০ শিক্ষার্থী। পুলিশি বাধা অতিক্রম করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সংলগ্ন সড়কে অবস্থান নেন শেকৃবি শিক্ষার্থীরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির বাধার মুখে পড়ে। প্রক্টর শিক্ষার্থীদের মহাসড়ক অবরোধ না করতে অনুরোধ করলে নাকচ করে দেন আন্দোলনকারীরা। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক ভেঙে সড়কে অবস্থান নেয়। সড়ক অবরোধ করলে প্রায় ২ শতাধিক পুলিশ শিক্ষার্থীদের বাধা দিতে গেলে তাদের সঙ্গে বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েন তারা। একপর্যায়ে পিছু হটে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা।
এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের তালা ভেঙে আন্দোলনে নামেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরা। পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, রায়সাহেব বাজার, তাঁতিবাজার, বংশাল, গুলিস্তান, শিক্ষা ভবন, হাই কোর্ট, মৎস্য ভবন মোড়ে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে শাহবাগে আসেন তারা।
রেলপথ ও মহাসড়ক অবরোধ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ও চবি অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীরা। নগরীর বটতলী স্টেশন অতিক্রম করে টাইগারপাস সড়ক অবরোধ করতে গেলে পুলিশের সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তি হয়। এতে তিনজন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন। পরে ষোলশহর ২ নম্বর গেট এলাকায় তাদের ওপর লাটিচার্জ করে পুলিশ। প্রতিবাদে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেট সংলগ্ন চট্টগ্রাম-রাঙামাটি মহাসড়ক অবরোধ করে। বন্ধ হয়ে যায় চট্টগ্রামের সঙ্গে রাঙামাটির সড়ক যোগাযোগ।
কুমিল্লায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে টিয়ার শেল ও ফাঁকা গুলি চালায় পুলিশ। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) সংলগ্ন আনসার ক্যাম্প এলাকার এ ঘটনায় সংবাদকর্মীসহ আহত হন অন্তত ১০ জন।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার কোটবাড়ী অংশে বিকাল ৪টার দিকে পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙেন আন্দোলনকারীরা। টায়ার ও গাছের গুঁড়িতে আগুন জ্বালিয়ে মহাসড়ক অবরোধ করেন তারা। আন্দোলনকারীদের সিংহভাগই ছিলেন ছাত্রী। শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদী গান ও কবিতা আবৃত্তিতে মেতে ওঠেন। আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় এদিন এক শিক্ষার্থীকে মারধর করে আবাসিক হল থেকে বের করে দেয় বর্তমানে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতারা। রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে সেখানকার ছাত্রলীগের নেতারা।
পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক অবরোধ করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা।
বৃষ্টির মধ্যেই খুলনার জিরোপয়েন্ট মোড় অবরোধ করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) শিক্ষার্থীরা। ফলে বন্ধ হয়ে যায় খুলনা-সাতক্ষীরা, খুলনা-বাগেরহাট, খুলনা-ঢাকা সড়কে বাস চলাচল। দিনভর এমন বিক্ষোভ-সংঘর্ষের মধ্যেই দাবি আদায়ে অনড় শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দেন আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার। পর দিনের কর্মসূচি হিসেবে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা বিকাল ৪টা থেকে বিক্ষোভ সমাবেশ ও ছাত্র ধর্মঘট পালন করবে বলে ঘোষণা করা হয়।