মহামারি করোনা চলাকালে মানুষের আয়-রোজগার যেমন কমে গিয়েছিল, সাধারণ মানুষের আয় তার চেয়েও বেশি কমেছে গত এক বছরে। যার ভুক্তভোগী বেশির ভাগই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত। এই শ্রেণির মানুষদের যতটুকু সঞ্চয় ছিল তার বেশির ভাগই ভেঙে খেয়ে ফেলেছেন। এখন তো তাদের অনেকেই ধারদেনা করেও সংসার চালাতে পারছেন না। কেননা, গত এক বছরে সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে এ শ্রেণির মানুষদের ভাগ্যে চরম এক দুর্দশা নেমে এসেছে। দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকেই। কমেছে আয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ। গত এক বছরে বেড়েছে আর্থিক বৈষম্য ও দারিদ্র্যের হার। ফলে জীবনমান কমছে সব শ্রেণির মানুষের। জানা গেছে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দেশের আর্থিক খাত পুরোটাই ওলট-পালট হয়েছে। গত এক বছরে অসংখ্যা শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। শেখ হাসিনার স্বৈরাচারের সঙ্গী হওয়ার অভিযোগ অনেক শিল্পোদ্যোক্তাকে জেলের ঘানি টানতে হচ্ছে। আবার জেলের বাইরে থেকেও শান্তিতে নেই বড় বড় শিল্প মালিকরা। কেননা ব্যবসায়ী ও শিল্প মালিকদের অকারণে হয়রানি করার অতীত সংস্কৃতি মোটেও বদলায়নি। ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি আর নির্বাচনি অনিশ্চয়তার কারণে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা আরও বেড়েছে। যদিও আগের তুলনায় অস্থিরতা কিছুটা কমেছে। এক বছরে অন্তত ৪ শতাংশ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্য সীমার নিচে নেমে গেছেন। বেশির ভাগ মানুষের আয় কমে গেছে। সরকারি তথ্য বলছে মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। এটা ঠিক যে একটা শ্রেণির মানুষের আয় তো বেড়েছে। যার ফলে গড় আয় বেড়েছে। অন্যদিকে আয় বৈষম্যও বেড়েছে। এদিকে গত এক বছরে বেকারও বেড়েছে ৫ লাখের মতো।
রাশেদুল ইসলাম। বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, গত এক বছরে পরিস্থিতি এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, নিজের ব্যাংক থেকেও ঋণ নিতে পারছি না। মার্জারের প্রশ্নে কর্মক্ষেত্রে সারাক্ষণই অস্থিরতা লেগে আছে। মানসিকভাবে কোনো স্বস্তি নেই। বেতন-ভাতা বাড়া তো দূরের কথা ব্যাংকটাই বোধ হয় বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে বাসাভাড়া মিটিয়ে দৈনন্দিন খরচ চালানো খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। উপমা রহমান। বেসরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। ৫ আগস্টের পর কোনো কারণ ছাড়ই চাকরিটা চলে গেছে। নিজে অসুস্থ। সংসারে আগে থেকেই কিছুটা আর্থিক টানাপোড়েন ছিল। সেটা এখন আরও বেড়েছে। লোক-লজ্জায় টিসিবির ট্রাকের লাইনেও দাঁড়াতে পারি না। সঞ্চয় যা ছিল তা তো আগেই ভেঙে ফেলেছি। এখন পরিচিত কারও কাছে ঋণ করতেও সংকোচ বোধ করি। চারদিকে অনিশ্চয়তা, ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থাও ভালো না। আমি নিজে ছোট একটা ব্যবসা করব ভাবছিলাম। গত কয়েক মাসে সেই পুঁজিও ভেঙে ফেলেছি। সামনে শুধুই অনিশ্চয়তা। জীবন-জীবিকার লড়াইয়ে নাস্তানাবুদ হচ্ছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ। নিদারুণ কষ্টে দিন কাটছে শ্রমজীবীদের। অপ্রাতিষ্ঠনিক খাতের মানুষের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছেন নগর-দরিদ্ররা। টিকতে না পেরে ঢাকা ছাড়ছে অনেক মানুষ। বেড়েছে যাতায়াত ও চিকিৎসা ব্যয়। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে হতবিহ্বল সাধারণ মানুষ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ডেঙ্গু ও সিজনাল ভাইরাস জ্বর। প্রায় প্রত্যেক ঘরে কেউ না কেউ অসুস্থ। এতে করে প্রতিদিন এই টেস্ট সেই টেস্টের পেছনেও বাড়ছে দৈনন্দিন ব্যয়। ফলে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং জীবন রক্ষার্থে নগদ সহায়তা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বেশির ভাগ মানুষেরই আয় কমে গেছে। এজন্য গত ৩ বছরে ১০ শতাংশ মানুষ নতুন করে দারিদ্র সীমার নিচে নেমে গেছে। করোনার সময়টাতে মানুষ ধারকর্জ করেছে বা সঞ্চয় ভেঙে জীবন নির্বাহ করেছেন। এখন কিন্তু সে অবস্থা নেই। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে খাবার কম খাচ্ছে। অনেকেই আবার কুলাতে না পেরে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনছে। অর্থাৎ ভাত, আলু, কিংবা ডালের পরিমাণ ঠিক রেখে মাছ, মাংস কম খাচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় পর্যন্ত নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের সংকট কাটানো কঠিন হবে বলে তিনি মনে করেন।